সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

নদীদূষণে আসে খোদার গজব

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নদীদূষণে আসে খোদার গজব

দুনিয়ার প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। সিন্ধুনদ, মিসরের নীলনদ এবং ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বড় বড় সভ্যতা। ভারতীয় উপমহাদেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের চিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। এক সময় নদীই ছিল বাংলাদেশের প্রাণ। বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করেই তো সৃষ্টি হয়েছে আজকের ঢাকা। শুধু ঢাকা নয় বাংলাদেশের যত বড় শহর-বন্দর ও নগর দেখতে পাই তার সবই এ নদীরই সন্তান। নদী বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। এদেশের জলবায়ুর ওপর নদ-নদীর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রেও নদীর ভূমিকা অপরিসীম। এসব নদ-নদী মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। এমনকি ইসলাম ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রেও এ নদীপথ ব্যবহার করেই প্রাচীন যুগের ইসলাম প্রচার করা বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেছেন। এক কথায় এদেশের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রচনাসহ শিল্পোন্নয়ন, বাণিজ্যের উন্নয়ন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, কর্মসংস্থান এবং কৃষির উন্নয়নে নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কোরআনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ মহাগ্রন্থে নদীর কথা উল্লেখ হয়েছে বারবার। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, ‘তিনিই কাজে লাগিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাছ খেতে পার, তা থেকে বের করতে পার পরিধেয় অলঙ্কার। তুমি তাতে জলযানগুলোকে পানি চিরে চলতে দেখবে এবং যাতে তোমরা আল্লাহর কৃপা অন্বেষণ কর। আর তিনি পৃথিবীর ওপর বোঝা রেখেছেন যে, কখনো যেন তা তোমাদের নিয়ে হেলেদুলে না পড়ে এবং নদী ও পথ তৈরি করেছেন, যাতে তোমরা তোমাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পার।’ (সুরা আন নাহল, আয়াত ১৪-১৬)। এখানে আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি কয়েকটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন। সে নেয়ামতের অন্যতম হলো- পানি ও প্রবহমান নদী। শুধু এখানেই নয়, কোরআনে কারিমের আরও বহু জায়গায় আল্লাহতায়ালা নদী সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। নদী প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমের সুরা নমলের ৬১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে- ‘তিনিই পৃথিবীকে করেছেন বসবাস উপযোগী এবং এর মধ্যে প্রবাহিত করেছেন নদী-নালা।’ সুরা যুমারের ২১ নম্বর আয়াতে আরও ইরশাদ হচ্ছে- ‘তুমি কি দেখ না আল্লাহপাক আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, তারপর ভূমিতে স্রোতরূপে তা প্রবাহিত করেন এবং তা দিয়ে বিচিত্র বর্ণের ফসল উৎপাদন করেন।’

জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদনে এবং ফল, ফসল ও জীবনের অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন তৈরিতে যে উদ্ভিদ বা গাছপালা, লতাপাতা প্রয়োজন, তার জন্য চাই নদী ও পানি। কোরআনের বাণী, ‘তিনিই আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, যিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জীবিকার জন্য ফলমূল উৎপাদন করেন, যিনি নৌযানকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তাঁর বিধানে তা সমুদ্রে বিচরণ করে এবং যিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন নদীগুলোকে।’ (সুরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩২)। দুঃখজনক সত্যি হলো- নদী ও পানি সম্পদের গুরুত্ব আমরা বুঝতে পারছি না। ফলে সুযোগ পেলেই অহরহ নদী ও পানি দূষণ করতে থাকি। কালের পরিক্রমায় আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে খাল-বিল, নদ-নদী হারিয়ে যাচ্ছে। খাল-বিল আগের মতো এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে। নদীর স্রোত হারিয়ে মরা নদীতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। কলকারখানার দূষিত বর্জ্যে নদী ও সমদ্রের পানি দূষিত হওয়ার ফলে নদী-নালা ও সমুদ্রে বসবাসরত মাছ ও অন্য প্রাণীদের জীবন আজ সংকটাপন্ন। আমাদের দেশের সব শহর ও বড় বাজার নদীপথকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল। কালের সাক্ষী বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, কর্ণফুলী ও হালদার এতটাই দূষিত যে পানির দুর্গন্ধে নদীর আশপাশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। গড়াই, মধুমতি, গোমতী, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, ব্রহ্মপুত্র, কুমার, তিস্তা নদী ক্রমান্বয়ে ফসলি জমিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। নদীদূষণের ফলে আমাদের পরিবেশ নষ্ট হয়ে জনজীবনে মারাত্মাক বিপর্র্যয় নেমে আসে। এর ফল আমরা হাতে হাতে পাচ্ছি। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা সতর্ক করে বলেছেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যার ফলে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম, : আয়াত ৪১)। আয়াতে সমুদ্রে বিপর্যয় বলতে আল্লাহতায়ালা নদীদূষণ, সমুদ্রদূষণ সম্পর্কেই সতর্ক করেছেন আমাদের। আসুন আমরা নদী ভালোবাসি, দূষণ বন্ধ করি।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর।

www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর