মঙ্গলবার, ১১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

ড. মাওলানা মুহাম্মদ লিয়াকত আলী

রবিউল আউয়াল রসুল (সা.)-এর জন্ম মাস। এ মাসের ১২ তারিখ পালন করা হয় ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) হিসেবে। ঈদ অর্থ যা বারবার আসে। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ামত বা অনুকম্পার কৃতজ্ঞতায় আনন্দ প্রকাশ। মিলাদ অর্থ জন্মদিন, জন্মকাল, জন্মস্থান ইত্যাদি। রসুল (সা.)-এর শুভাগমন স্মরণে আনন্দ উদযাপন, তাঁর শুভাগমনকে নিয়ামতরূপে গ্রহণ ও তাঁর আগমন সম্পর্কে আলোচনা করা। ইসলামী পরিভাষায় হলো মিলাদ, মাওলিদ, মৌলুদ, মিলাদুন্নবী। ইরশাদ হয়েছে, ‘(হে রসুল), আপনি স্মরণ করুন (ওই দিনের ঘটনা), যখন আল্লাহ আম্বিয়ায়ে কেরামের কাছ থেকে এভাবে অঙ্গীকার নিয়েছেন, যখন “আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত” অর্থাৎ নবুয়ত দান করেছি, এরপর তোমাদের কাছে এক মহান রসুলের শুভাগমন হবে যিনি তোমাদের প্রত্যেকের নবুয়তের সত্যায়ন করবেন, তখন অবশ্যই তোমরা সবাই তার ওপর ইমান আনবে এবং সর্বোত্তমভাবে তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে। তোমরা কি এ কথার অঙ্গীকার করছ এবং অঙ্গীকারে কি অটল থাকবে? সব নবী বললেন হ্যাঁ, আমরা অঙ্গীকার করলাম। আল্লাহ বললেন, তোমরা পরস্পর সাক্ষী থাকো এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী রইলাম। এর পরও যারা ফিরে যাবে তারা হবে ফাসেক।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৮১-৮২) এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় অন্যান্য নবী (আ.) থেকে আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছিলেন (ইবারাতুন নাস), সব নবী (আ.) সেদিন মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন (দালালাতুন নাস), মাহফিলটি নবীজির আগমন বা মিলাদুন্নবী সম্পর্কিত ছিল (ইশারাতুন নাস) এবং তখন সব নবী (আ.) আদব বা শিষ্টাচার প্রকাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন (ইকতিজাউন নাস)। এ আয়াতে আল্লাহ ‘মিলাদুন্নবী’ নবীজির আগমন সম্পর্কে রোজ আজলের মধ্যে সব নবীকে (আ.) উপস্থিত রেখে আলোচনা করেন। নবী করিম (সা.) আল্লাহর এমন প্রিয় রসুল, যাঁর সঙ্গে মানুষের কোনোভাবেই তুলনা দূরে থাক, অন্য কোনো নবীর সঙ্গেও তুলনা হওয়ার নয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানবকুল! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে এবং অন্তরগুলোর বিশুদ্ধতা, হেদায়াত এবং রহমত ইমানদারদের জন্য। হে রসুল! আপনি বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়া প্রাপ্তিতে তারা যেন আনন্দ প্রকাশ করে। এটা তাদের সব ধনদৌলত সঞ্চয় করা থেকেও অতীব উত্তম।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত ৫৭-৫৮) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম জালালুদ্দিন আস সুয়ুতি (রহ.) তাফসির ‘আদ্ দুররুল মানসুর’-এ উল্লেখ করেন, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, এখানে আল্লাহর অনুগ্রহ দ্বারা ইলমে দীন বোঝানো হয়েছে। আর রহমত দ্বারা হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রহমাতাল্লিল আলামিন। অর্থাৎ হে হাবিব আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত করেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭; তাফসিরে রুহুল মাআনি, তাফসিরে কাবির, ইমাম সুয়ুতি, তাফসির আদ্ দুররুল মানসুর) ইরশাদ হয়েছে, ‘মারিয়াম-তনয় ইসা (আ.) আরজ করলেন, হে আল্লাহ! হে আমাদের রব! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে একটা খাদ্যখাঞ্চা অবতরণ করুন। যা আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী সবার জন্য ঈদ হবে এবং আপনারই নিদর্শন হবে, সুতরাং আমাদের রিজিক দান করুন। আর আপনিই হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ রিজিকদাতা।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত ১১৪) এ আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয়, আল্লাহর পক্ষ থেকে খাঞ্চাভরা খাদ্য এলে তা যদি হজরত ইসা (আ.)-এর ভাষায় পূর্ব ও পরবর্তী সবার জন্য আনন্দ-উৎসবের বহিঃপ্রকাশ ও আল্লাহর নিদর্শন হয়, তাহলে সৃষ্টির সর্বোত্তম, রহমতের ভান্ডার, প্রিয় নবী (সা.)-এর মতো মহান, অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় নিয়ামতের শুভাগমনের দিন উম্মতের জন্য কতই মর্যাদাবান, গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের দিন বা মাস তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ মুসলমানদের প্রতি বড়ই কৃপা করেছেন, ইমানদারের জন্য তাদের মধ্য থেকে এক রসুল প্রেরণ করেন। যিনি তাদের কাছে আল্লাহর বাণী পড়েন, তাদের অন্তর পাক করেন, তাদের কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দান করেন। এর আগে তারা স্পষ্ট পথভ্রষ্টতায় ছিল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৬৪) এ আয়াতে আল্লাহ নবী প্রেরণের কথা উল্লেখ করে মহান অনুগ্রহের বর্ণনা দিয়েছেন। এতে প্রতীয়মান হয়, আল্লাহর হাবিবের অলৌকিক ও অতুলনীয় শুভাগমন উপলক্ষে রসুলপ্রেমিক ইমানদাররা ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপনের মাধ্যমে এ বেমেসাল নিয়ামতের শুকর আদায় করেন। মিলাদবিরোধীরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন থেকে বিরত থাকেন। সুতরাং ঈদে মিলাদুন্নবীর বিরুদ্ধাচরণ বেআদবির আলামত। যাদের মধ্যে নবীর যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শনে বিদ্বেষভাব রয়েছে তারা ঈদে মিলাদুন্নবী অস্বীকার করে। একে বিদাত বলে। মুসলমান হয়েও যারা নবীর যথাযথ মানমর্যাদা প্রকাশে অনীহা ও বিদ্রƒপ করে তারা কাফেরতুল্য। হাদিসেও ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। নবী (সা.) নিজেও মিলাদ পালন করেন। যেমন হজরত আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.)-এর দরবারে আরজ করা হলো- তিনি প্রতি সোমবার কেন রোজা রাখেন? উত্তরে নবীজি ইরশাদ করেন, ‘এদিন আমার আগমন হয়েছে, এদিন আমি প্রেরিত হয়েছি এবং এদিনেই আমার ওপর কোরআন নাজিল হয়।’ (মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, মুসান্নাফ আবদুর রাজ্জাক, হিলিয়াতুল আউলিয়া)।

লেখক : অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম

সর্বশেষ খবর