সোমবার, ৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

দক্ষ জনশক্তির বিকল্প নেই

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে দক্ষ করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। অনেক দেশ এখন বয়োবৃদ্ধের দেশে পরিণত হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের বড় বিষয় হলো আমাদের বিপুলসংখ্যক যুব শ্রেণি আছে। শ্রমবাজারে যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে যুবকদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে। সারা বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের প্রধান রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক সেক্টরে হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিক উচ্চ বেতনে কাজ করছে। এভাবে দেশ থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার বিদেশে চলে যাচ্ছে। মূলত তৈরি পোশাক খাত এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। এ দুই খাতে নিজস্ব দক্ষ জনশক্তির অভাবে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা চরমভাবে মার খাচ্ছে। একজন অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও বেতন-ভাতা অনেক বেশি। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার কারণে একদিকে যেমন বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্য রেমিট্যান্স থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি, অন্যদিকে দেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে অর্জিত রেমিট্যান্সও দেশে রাখতে পারছি না। বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানে শতকরা ৯০ ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। এদের শ্রমের মজুরি অন্যান্য দেশের দক্ষ জনশক্তির চেয়ে অনেক কম। আশার কথা হচ্ছে, দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা সদর ও উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি শত শত কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) থেকে যেসব শ্রমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়ে আসছে এদের জন্য দেশে-বিদেশে যথাযথ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এমন বাস্তবতায় বিকল্প শ্রমবাজার অনুসন্ধান ও কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। সম্ভাব্য দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় জনশক্তির চাহিদার প্রতি লক্ষ রেখে উপযুক্ত কর্মী প্রশিক্ষণ ও জনবল গড়ে তোলার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সময়ের চাহিদা অনুসারে শ্রমিকের আধুনিক প্রযুক্তিগত ও কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি নির্দিষ্ট দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও সিভিক নিয়ম-কানুনও প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। শুধু কারিগরি শিক্ষাই নয়, দেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাকেও সময়ের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংস্কার বা ঢেলে সাজানোর সুচিন্তিত উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের নামে মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে। বছরের পর বছর ধরে এ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। প্রতি বছর কত মানুষ পাচারের শিকার হয় তার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। বিদেশে-বিভুঁইয়ে পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশিদের গ্রেফতার কিংবা জিম্মি হওয়াসহ মৃত্যুর খবর প্রায়ই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এতে অনুমান করা যায়, পাচারের সংখ্যা মোটেই কম হবে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, যারা পাচার হচ্ছে তারা দেশের সক্ষম জনসংখ্যারই অংশ। তারা পাচারকারীদের কবলে পড়ে বিদেশের পথে পথে বা বিদেশে বিড়ম্বিত, লাঞ্ছিত, আটক ও জিম্মি হওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের কর্মসক্ষমতা বিনাশ করছে। প্রতারিত ও হতাশ হয়ে দেশে ফিরে আসছে। অনেকে মৃত্যুবরণও করছে। এটা দেশের কর্মশক্তির ক্ষয় ও অপচয়। মানব পাচার মানে শুধু মানুষই পাচার নয়, এর সঙ্গে টাকাও পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে চাকরিতে যাওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতে হয়। সঙ্গেও নগদ কিছু নিয়ে যেতে হয়। আর আটক কিংবা জিম্মিদশায় পড়লে দেশ থেকে লাখ লাখ টাকা গুনে তবে মুক্তি পেতে হয়। মানব পাচারের মতো অপরাধ দমন বা নিরোধ করতে হলে প্রথমত, দেশব্যাপী মোটিভেশন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনকে আরও কঠোর করতে হবে। তৃতীয়ত, এ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তন কিংবা চাকরির জন্য বিদেশে যেতে হলে চোরাপথ বা অবৈধ পথ পরিহার করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যেতে হবে। টাকা-পয়সা দেওয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বচ্ছতার আশ্রয় নিতে হবে।

উল্লেখ্য, কারিগরি শিক্ষা হচ্ছে বর্তমানে জীবিকা অর্জনের একটি মাধ্যম। দেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে দেশে এখন দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল বিদেশে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে। কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে আমরা বিপুল পরিমাণ দক্ষ জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছি। তাই সবাইকে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পরিশেষে বলছি, যারা বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য নির্বাচিত হবেন তাদের অবশ্যই বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে যাতে তারা সংশ্লিষ্ট দেশে কোনোরূপ অনভিপ্রেত পরিস্থিতির শিকার না হন। এটা দুঃখজনক যে, বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের কর্মীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। রোগ, দুর্ঘটনা ও নানা অপঘাতে কর্মীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের দূতাবাসগুলোকে এসব দেশে কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের কল্যাণ, বেতন ভাতা, সমস্যা-সংকট এসব বিষয়ে বিশেষত নজর দিতে হবে। যেসব দেশের শ্রমবাজারে সমস্যা আছে সেসব দেশে বিশেষ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে সমস্যা-জটিলতার সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অপতৎপরতা রোধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি রেমিট্যান্স যা প্রবাসীদের মাধ্যমে আসে, সুতরাং রেমিট্যান্স কমে আসার কারণগুলোর প্রতি যেমন যথাযথ দৃষ্টি দিতে হবে তেমন নতুন শ্রমবাজার পেতে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ

সর্বশেষ খবর