বুধবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্মরণ : বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ

সুমন পালিত

স্মরণ : বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ছিলেন পাকিস্তান আমলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় অনন্য ভূমিকা রেখেছেন এই গুণী মানুষটি। সংস্কৃতিমনা ও রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তিনি সামরিক শাসকের ভ্রƒকুটিকে পাত্তা দেননি কোনোভাবেই। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করার বদলে প্রধান বিচারপতির মতো মর্যাদাবান পদে থেকে সরে দাঁড়ানোর সৎ সাহসও দেখিয়েছেন তিনি। সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ছিলেন সুনীতি ও সুবিবেচনার প্রতীক। জাগ্রত বিবেকের প্রতিবিম্ব বলেও অভিহিত করা হয় তাকে। এসব গুণ তিনি পেয়েছিলেন অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রেই। ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগ্নে ছিলেন বিচারপতি মোর্শেদ। অসীম সাহস ও আপসহীনতার গুণটি তিনি পেয়েছেন মাতুল সূত্রে। শেরে বাংলা ছিলেন সেরা বাঙালি, সেরা মুসলমান এবং সংস্কৃতিসেবী। বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের ক্ষেত্রেও কথাগুলো সমানভাবে প্রযোজ্য। বিচারপতি হিসেবে তিনি সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের পক্ষে তাঁর অখণ্ড অবস্থানের প্রমাণ রেখেছেন। অসত্য, অসুন্দর ও অকল্যাণের বিপরীতে ছিল তাঁর অবস্থান। বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদের অনেক রায় ম্যাগনাকার্টা হিসেবে পরিচিত আইনের জগতে। ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সবার’-এই মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। এ গুণাবলিও তিনি পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। কলকাতা হাই কোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি স্যার সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের পূর্বপুরুষ। তিনি ১৮৯০ সালে ওই মর্যাদাবান পদে অধিষ্ঠিত হন। তার পুত্র সৈয়দ তারেক আমীর আলীও ছিলেন হাই কোর্টের বিচারপতি। আরেক পূর্বপুরুষ মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ ছিলেন দেওয়ানি আদালতের বিচারক। সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ হজরত ইমাম হোসেনের উত্তরপুরুষেরই একজন। সৈয়দ উপাধিটি এসেছে সেই সূত্রেই। সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের বাবা সৈয়দ আবদুস সালেক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদে তিনি তৎকালীন পূর্ববাংলার বিভিন্ন জেলায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর মা আফজালুন্নেছা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের জন্ম ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ সালে এমএ এবং ১৯৩৩ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। লন্ডনের লিংকন্স ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে ১৯৩৯ সালে তিনি কলকাতা হাই কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা হাই কোর্ট বারে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে মাহবুব মোর্শেদ ঢাকা হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন। ১৯৬২-৬৩ সাল মেয়াদে তিনি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৬৭ সালের ১৫ নভেম্বর পদত্যাগ করেন। বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ঢাকায় আইনজীবী হিসেবে তার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠনে রেখেছেন তাৎপর্যপূর্ণ অবদান। ১৯৬১ সালে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তিনি ঢাকায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

বিচারক হিসেবে মাহবুব মোর্শেদের খ্যাতি প্রায় আকাশছোঁয়া। বিচারপতির মর্যাদা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য তিনি কঠোর প্রয়াস চালিয়েছেন। ‘মন্ত্রীর মামলা’, ‘কর্নেল ভট্টাচার্যের মামলা’ ও ‘পানের মামলা’য় তাঁর ঐতিহাসিক রায় ন্যায়নিষ্ঠার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিচারপতি মোর্শেদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচার ব্যবস্থার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিতের পর বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি নিম্ন আদালতের উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রাম জোরদার হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তাকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা নিজেদের অস্তিত্বের জন্য বিপদ হিসেবে দেখতে শুরু করে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে স্তব্ধ করার প্রক্রিয়া। কারণ ব্যক্তি মুজিব ষাট দশকে হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। তাঁকে স্তব্ধ করতে আনা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। ঠিক এমন মুহূর্তে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ প্রধান বিচারপতি পদ থেকে সরে দাঁড়ান। মর্যাদাপূর্ণ পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে জনতার কাতারে অবস্থান নেওয়ার যে সৎ সাহস তিনি দেখিয়ে ছিলেন তা ছিল নজিরবিহীন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনায় প্রস্তুতি গ্রহণে তিনি যেমন উদ্যোগী ভূমিকা রেখেছেন তেমন জনমত গঠনে রেখেছেন অবদান। প্রধান বিচারপতি থেকে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের পদত্যাগ দেশের বিবেকবান মানুষের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তিনি দলীয় রাজনীতিতে কখনো জড়াননি। তবু ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের নেপথ্যে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের সক্রিয়তা ছিল। ১৯৫৪ সালের ২১ দফা প্রণয়নে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ভাগ্নে সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের সহায়তা নেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার প্রতি তাঁর সমর্থন আন্দোলন বেগবানের ক্ষেত্রে অবদান রাখে। স্মর্তব্য, ১১ দফায় বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দাড়ি, কমাসহ একীভূত হয়েছিল। বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল ইন্তেকাল করেন। ৬৮ বছরের জীবনে তিনি আলোকবর্তিকা হিসেবে ধারেকাছের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদের পুণ্য স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

সর্বশেষ খবর