শনিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঝিনুকের মুক্তায় আসুক নতুন ঝিলিক

শাইখ সিরাজ

ঝিনুকের মুক্তায় আসুক নতুন ঝিলিক

ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশে স্টেডিয়াম মার্কেটে বেশ কিছু রত্ন-পাথরের দোকান আছে। সেখানে সারি সারি দোকানে রত্ন-পাথরের পাশাপাশি রয়েছে মুক্তার সংগ্রহও। নানান আকারের মুক্তা। কোনোটি ছোট, কোনোটি বড়। এক দোকানি আল-আমিন জানালেন, এসব মুক্তা আসে চীন ও ভারত থেকে। বাংলাদেশেও মুক্তার চাষ হচ্ছে এখন। বাংলাদেশের মুক্তার আকার বেশি বড় হয় না। তবে চাহিদার একটা অংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত মুক্তায় মিটছে বলে দাবি করলেন আল-আমিন।

দারুণ এক প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফসল মুক্তা। গহনা ও অলংকার হিসেবে যা গোটা পৃথিবীতেই কমবেশি ব্যবহার হয়ে আসছে। যে কারণে রত্ন-পাথরের নাম এলেই মুখে আসে মুক্তা। মণি-মুক্তা-জহরত। এই মুক্তা ঝিনুকের দেহে জৈবিক প্রক্রিয়ায় তৈরি এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। যা শুধু অলংকার হিসেবেই নয়, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন রোগের ওষুধ ও প্রসাধন হিসেবে ব্যবহার হয়। যে কারণে এর চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। ফলে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মুক্তা এখন চলে এসেছে চাষ ব্যবস্থাপনায়। যা এখন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে টিস্যু প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে কালচার করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় চীন, জাপান, ভিয়েতনাম বাণিজ্যিকভাবে অনেকটাই সফল। আমাদের দেশের মাটি ও পানির রাসায়নিক গুণাগুণও মুক্তা চাষের জন্য উপযোগী। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে ঝিনুকে মুক্তা চাষের কার্যক্রম নিয়ে আমি প্রতিবেদন তুলে ধরেছিলাম হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের তথ্যমতে, এখন দেশের ৪১টি জেলার ৯০টি উপজেলায় মোট ১৫০ জনের অধিক প্রান্তিক খামারি মুক্তা চাষি রয়েছেন। যাদের হাতে প্রায় ৬ লাখ ঝিনুকে মুক্তা চাষ হচ্ছে। আহরিত মুক্তা তারা অলংকার তৈরির কাঁচামাল হিসেবে বিক্রি করছেন। আবার কেউ কেউ নিজ উদ্যোগে দেশ-বিদেশে অনলাইনে সরাসরিও বিক্রি করছেন। গত নভেম্বরে বরিশাল-পটুয়াখালী জেলা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সেখানকার কৃষি বৈচিত্র্য। পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সদরের ধুলাসার গ্রামের এক তরুণের সাক্ষাৎ পেলাম, যিনি মুক্তা চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণ সুজন হাওলাদার বছর তিনেক আগে যুক্ত হয়েছিলেন মুক্তা চাষে। এখন তার তিনটি পুকুরে মাছের পাশাপাশি চলছে ঝিনুকে মুক্তা চাষ।

পুকুরের মাঝে বাঁশের খুঁটিতে জালের ভিতর বিশেষ কৌশলে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে ঝিনুক। সারি বাঁধা প্লাস্টিকের বোতল ভাসছে পুকুরজুড়ে। এই বোতল মূলত ঝিনুকগুলোকে পুকুরের তলদেশের মাটি থেকে ওপরে ঝুলিয়ে রাখতে ব্যবহার হয়। আর ঝিনুকের মাঝেই সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তা। সুজন হাওলাদার পুকুর থেকে বেশ কিছু ঝিনুক তুলে আনলেন। গ্রামের পুরনো পুকুর, বিল-ঝিল থেকে সংগ্রহ করে আনেন ঝিনুক। সেই ঝিনুকে চাষ করেন মুক্তার। সুজন দেখালেন কী করে ঝিনুকের অপারেশন করে ভিতরে মুক্তার জন্য ডাইস বা মেডিসিন দিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে তারা এ বিষয়টিকে বলেন সার্জারি। সাধারণত দুই ধরনের মুক্তা তৈরি করেন সুজন। একটি ডাইস দিয়ে তৈরি কোনো অলংকরণ বা নাম, যেটিকে তারা বলছেন ইমেইজ মুক্তা। অন্যটি গোল মুক্তা।

সুজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল বেশ বুঝেশুনেই মুক্তা চাষ করছেন তিনি। বললেন, এখন পর্যন্ত এখানে তৈরি হয়েছে ১০ হাজার মুক্তার দানা। মুক্তা চাষের গোটা প্রক্রিয়াটিই একটু সময়সাপেক্ষ। এক অর্থে বাড়তি ফসলের মতোই মাছ চাষের সাথী ফসল মুক্তা। যা বিনিয়োগের তুলনায় যথেষ্টই লাভজনক- বলছিলেন সুজন হাওলাদার। ঝিনুক সংগ্রহ করতে শ্রমিক খরচ যায় ঝিনুক প্রতি ২ টাকা। ডাইসের দাম ৫ টাকা। জাল, দড়ি প্রভৃতিসহ প্রতি ঝিনুকে বছরে খরচ হয় ২০ টাকা। প্রতিটি ঝিনুক থেকে প্রাপ্ত মুক্তা বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা করে। মান ভালো হলে ৬০০ টাকা, মান খারাপ হলে ন্যূনতম ৩০০ টাকা। অর্থাৎ ঝিনুক প্রতি লাভ বছরে কমপক্ষে ২৮০ টাকা। সুজনের পুকুরে আছে সাড়ে ৪ হাজার ঝিনুক। তাহলে এক বছরে তার লাভ থাকছে ১২ লাখ টাকার ওপরে। ঝিনুকের পরিমাণ বাড়াতে পারলে বিষয়টি নিঃসন্দেহে লাভজনক।

সুজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে পড়ে গেল বছর তিনেক আগের কথা। পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার ভরতপুর গ্রামের তরুণ মোহাম্মদ আল মামুন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করেও চাকরির পথ বেছে না নিয়ে তিনি নেমেছেন মুক্তা চাষে। মুক্তা থেকেই খুঁজে নিয়েছিলেন নিজস্ব আয়ের পথ।

মামুন কিংবা সুজনের মতো দেশের অনেক তরুণের কাছেই আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ দেখাচ্ছে মুক্তা চাষ। যা দেখে নতুন করে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনেকেই। কিন্তু মুক্তা চাষকে স্থায়ীকরণে দরকার মুক্তার বাজার সম্পর্কে উদ্যোক্তাদের ধারণা পরিষ্কার হওয়া। পাশাপাশি উন্নত মানের মুক্তা উৎপাদনে চাই উন্নত জাতের ঝিনুক। ঝিনুকের জাত নিয়েও প্রয়োজন গবেষণার। নেদারল্যান্ডসে বড় বড় ঝিনুকে উন্নত মানের ঝিনুক চাষ করতে দেখেছি।

ঝিনুকে অমূল্য রত্ন মেলে ঠিকই। তবে সব ঝিনুকেই মুক্তা মেলে না। ঝিনুকে মুক্তা চাষের জন্য দরকার হয় বিজ্ঞানসম্মত ধ্যান-ধারণা ও জ্ঞান। বিশেষ করে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তা চাষ করে দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের। যার জন্য দরকার আধুনিক ও সময়োপযোগী প্রযুক্তি বিষয়ে উদ্যোক্তাদের জানা-বোঝা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীরুল ইসলাম। তিনি মুক্তার বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা বললেন। সুজন বললেন, মুক্তা চাষ করে তা বাজারজাত করার ক্ষেত্রে অন্যতম দরকারি বিষয় হচ্ছে মুক্তার ডিজাইনকে ইচ্ছামতো কাটিং করে তা ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়া। যে কৌশলটি ব্যক্তি উদ্যোগে রপ্ত করেছেন রংপুরের লালমনিরহাট সদরের পূর্বদৈলজর গ্রামের মুক্তা চাষি রুহুল আমিন লিটন। তিনি তা শিখে এসেছেন ভারত থেকে। সুজন মনে করেন, সরকার যদি ঝিনুক চাষ কৌশল থেকে শুরু করে বাজারজাত করার প্রতিটি ধাপের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনা তৈরি করে দেয়, তবে মুক্তার চাষ আরও বেশি সম্ভাবনাময় হবে। ঝিনুকে মুক্তা প্রাপ্তির গল্প নতুন কোনো বিষয় নয়। অলংকার শিল্পে মুক্তার ব্যবহারও দীর্ঘকালের। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত অমূল্য রত্ন সম্ভারের ক্ষেত্রেও মুক্তার অবস্থান অতি পরিচিত। এ ছাড়াও মুক্তার ব্যবহার হচ্ছে ওষুধ ও প্রসাধন শিল্পে। এ জন্য পৃথিবীর অনেক স্থানেই নিবিড়ভাবে মুক্তার চাষ হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও বহু আগেই শুরু হয়েছে মুক্তা চাষ। ঝিনুকে মুক্তা চাষ পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। আবার মাছের সঙ্গে বাড়তি ফসল হিসেবে ঝিনুকে মুক্তা চাষ করতে বাড়তি কোনো খাবারও লাগে না। এ জন্য স্বল্প সময়ে স্বল্প পুঁজিতে যে কারও পক্ষেই সম্ভব মুক্তা চাষে যুক্ত হওয়া। আমার বিশ্বাস, সুজন হাওলাদারদের মতো তরুণরা যেভাবে মুক্তা চাষকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তাদের দেখাদেখি অন্য উদ্যোগীরাও এগিয়ে আসবেন। এতে সৃষ্টি হতে পারে বহু মানুষের কর্মসংস্থান, সৃষ্টি হতে পারে অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনা। সরকার এ বিষয়ে আরও সুপরিকল্পিত ও বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেবে-এই প্রত্যাশা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর