শনিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

শীতকালীন রোগ-সতর্কতা ও তার প্রতিকার

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

শীতে যেসব রোগবালাইয়ের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় তা নিয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর এই পরিবর্তনের সময়টাতে অনেকেই নানা অসুখে ভুগতে শুরু করেন। শ্বাসযন্ত্রের নানা অসুখ-বিসুখ মানুষকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দেয় যেমন- সর্দি, কাশি, হাঁচি ও নিঃশ্বাসে কষ্ট। এ সময় কারও ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা হলে তা সহজে না সারার প্রবণতাসহ বিভিন্ন শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া এ সময়ে যক্ষ্মা, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ (কনজাংটিভাইটিস), শিশুদের ডায়রিয়া প্রকোপ দেখা দিতে পারে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে শরীরকে খাপ-খাওয়ানোর সময়ে বিভিন্ন শীতকালীন অসুখ আমাদের শরীরে আক্রমণের সুযোগ নেয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভৌগোলিক কারণে আবহাওয়া ও পরিবেশেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে। কারও কারও অ্যালার্জি সমস্যা এ সময়ে বাড়ে। এমনটা ঘটে কারণ আমাদের শরীর কোনো পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের জন্য সময় নেয়। তাই হঠাৎ এই তাপমাত্রা বা আবহাওয়ার পরিবর্তন মানুষকে নানা অসুখে ভোগানোর জন্য দায়ী। কিন্তু কিছু বিষয় খেয়াল রাখলে সহজেই এগুলোকে দূরে রাখা বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তেমন কিছু রোগ সম্পর্কে জেনে রাখুন :

ভাইরাস জ্বর : আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাস জ্বরের আবির্ভাব বেশ পরিচিত একটা সমস্যা। শীতকালে ভাইরাস জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। বিভিন্ন ভাইরাস যেমন-অ্যাডিনোভাইরাস, রাইনোভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং অধুনা কভিড-১৯ ভাইরাস ইত্যাদি মূলত ভাইরাস জ্বরের জন্য দায়ী। শিশু, বয়স্ক ও যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম যেমন-ডায়াবেটিস, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, কিডনি ও লিভারের রোগ আছে তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, প্রচুর তরল জাতীয় খাবার বিশেষত স্যুপ, খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, লেবু চিনির শরবত এ সময় বেশ উপকারী। ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। প্রয়োজনে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেন। ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত হলে ঠাণ্ডা পানীয়/আইসক্রিম সম্পূর্ণ নিষেধ। ভাইরাস জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। যাদের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (যেমন : অ্যাজমা, সিওপিডি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস) আছে তাদের ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোকক্কাল ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত। শিশুদেরও ভ্যাকসিন দেওয়া যেতে পারে।

অ্যালার্জি অ্যাজমা : শীতকালের বেশ পরিচিত সমস্যা হচ্ছে অ্যালার্জি ও অ্যাজমা। শীতকালে অ্যালার্জি ও অ্যাজমা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। এ রোগ দুটি অনেক ক্ষেত্রে একসঙ্গে হয়। যদিও যে কোনোটির প্রকাশ আগে-পরে হতে পারে। এ সময়ে ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা বেড়ে যায় এবং বারবার সর্দি হাঁচি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ সৃষ্টি ও আওয়াজ হয়। যেসব কারণে অ্যালার্জি হয় সেসব থেকে দূরে থাকা জরুরি। প্রয়োজনে অ্যালার্জির ওষুধ, নাকের স্প্রে এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ইনহেলারও ব্যবহার করতে হতে পারে। এ সময় অনেকে আবার সাইনোসাইটিসের সমস্যায় ভোগেন। সাইনোসাইটিসের লক্ষণ হতে পারে বারবার মাথাব্যথা, সর্দি-কাশির প্রবণতা, কাশতে কাশতে বমি হওয়া, জ্বর ইত্যাদি। কোনো কিছুতে অ্যালার্জি থাকলে সেদিকে নজর দিতে হবে। অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন প্রয়োজন হতে পারে। তবে তা যেন যৌক্তিক পর্যায়ে হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

ফুসফুসে সংক্রমণ/প্রদাহ/ নিউমোনিয়া : শীতের সময়ে অনেকে আবার ফুসফুসের সংক্রমণের সমস্যায় ভোগেন। ফুসফুসের সংক্রমণকে সাধরণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়। আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ যা সাধারণত ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। আর লোয়ার রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ যা অধিকাংশ সময় ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। তবে ভাইরাল নিউমোনিয়াও হতে পারে। জ্বর, কাশি, কফ, শরীর ব্যথা ও বমি বমি ভাব হলো ফুসফুস সংক্রমণের লক্ষণ। ভাইরাল নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে সর্দি, হাঁচি ও নাক দিয়ে পানি পড়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। সাধারণত শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এগুলো বেশি দেখা যায়। শীতে এসব রোগের হাত থেকে নিরাপদ থাকতে বেশ কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হয়।

আসুন জেনে নেওয়া যাক প্রয়োজনীয় টিপসগুলো : শীতের সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রতিদিন উষ্ণ গরম পানি বা যে কোনো গরম পানীয় যেমন- চা কফি, স্যুপ, দুধ খাওয়া ভালো। বেশি শীতে শুধু একটা ভারী কাপড় না পরে একাধিক পোশাক পরিধান করুন। শীতে ভিটামিন সি জাতীয় খাবার বেশি খাওয়া উচিত। ভিটামিন সি ঠাণ্ডা লাগার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। ঠাণ্ডা লাগলে বা বেশি কাশি হলে আদা ও লবঙ্গের রস বেশি কার্যকরী। আদা ও লবঙ্গের রস ঠাণ্ডা কাশি কমাতে সাহায্য করে। আদা ও লবঙ্গ দিয়ে চা খুবই কার্যকর।

শীতের সকাল-বিকাল নাক বন্ধ মনে হলে নাকে গরম পানির ভাপ নিলে ভালো বোধ হয়। শীতে পানি খাওয়া কম হয়। যে কারণে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। সে জন্য পানি জাতীয় গরম খাবার বেশি খেতে হয়। শীতকালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা বেশি প্রয়োজন। শীতে ধুলাবালু বেশি থাকায় তাতে রোগজীবাণু বেশি থাকে এবং সে কারণে অসুখে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ ছাড়া সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি যেমন নিয়মিত হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলা, ধূমপান পরিহার করা, ভ্যাকসিন নেওয়া ইত্যাদি অনেক সাধারণ শ্বাসতন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ করতে পারে। বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে শিশু ও বৃদ্ধদের দিকে কারণ তারাই সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। শিশু যদি ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেয় বা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মায়ের দুধ খেতে না পারে অথবা নিস্তেজ হয়ে পড়ে তবে অবশ্যই তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এ সময়ে সতর্কতা ও সচেতনতাই অনেক রোগবালাই থেকে দূরে রাখতে পারে। এভাবে শীতকালে সামান্য সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সুস্বাস্থ্য রক্ষা করে এই সময়টাকে উপভোগ করা সম্ভব। উৎসবমুখর এই ঋতু সবার জীবনে স্বস্তিদায়ক হোক- এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ ও কোষাধ্যক্ষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর