বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে কিছু কথা

মেজর অব. আখতার

মুদ্রানীতি প্রসঙ্গে কিছু কথা

২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জানুয়ারি-জুনকালীন মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময় ঘোষণা করেছে যখন ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট বিরাজ করছে। মুদ্রানীতি হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য দেশের আর্থিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত নীতি, যা দেশের অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পক্ষে সেই দায়িত্বটি পরিচালনা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক সামষ্টিক, অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক এবং বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অবস্থা অনুমান করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে থাকে। ১৯১৩ সালে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকব্যবস্থা ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ঋণের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সময়ের বিবর্তনে সবাই এটা অনুধাবন করতে পেরেছে যে, সুদের হারের সঙ্গে গোটা অর্থনীতির একটা সম্পর্ক আছে। যার ফলে পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিরায়িত কাজ শুধু মুদ্রা ছাপা ও মুদ্রার মান বজায় রাখাই নয় বরং তাদের সেই কাজের চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে দাঁড়ায় সুদের হার নিয়ন্ত্রণের কথা বিবেচনায় নিয়ে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও পরিচালনা করা।

মুদ্রানীতি বিশ্বের সব দেশের জন্য এক নয়। মুদ্রানীতির লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নির্ভর করে মূলত একটি দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। তাই একটি উন্নত দেশের মুদ্রানীতি ও একটি অনুন্নত বা স্বল্প উন্নত দেশের মুদ্রানীতি একরকম হবে না। তবে সাধারণত প্রায় সব দেশের মুদ্রানীতির প্রধান লক্ষ্যগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা, বিনিময় হার সুদের হার নিয়ন্ত্রণ এবং বেকারত্ব হ্রাস করা। যে কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত এ লক্ষ্যগুলোকে যথাযথ বিবেচনা করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও পরিচালনা করে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যখন মূল্যস্ফীতি এবং সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় তখন বেকারত্ব হ্রাস পায় অর্থাৎ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়, যার ফলশ্রুতিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রণীত ও পরিচালিত মুদ্রানীতি আলোচনা ও বিবেচনা করার আগে ওপরে উল্লিখিত লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বিবেচনা করা মনে হয় অনেক বেশি যুক্তিসংগত হবে। প্রথমেই ধরা যাক মূল্যস্ফীতির বর্তমান হালহকিকত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর গত ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে জানা যায়, মূল্যস্ফীতি ৮.৭১% শতাংশে দাঁড়িয়েছে, আর গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭.৭০% হয়েছে। সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৫.৬% ধরে রাখার পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছিল। যদিও সরকার তখন সংশোধিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৬. ৫০% নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তা মানতে রাজি নয় এবং তারা বলছে প্রবৃদ্ধি ৫.২০% এর মধ্যে থাকবে। মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। কাজেই এটি বুঝতে কোনো জগৎসেরা অর্থনীতিবিদের প্রয়োজন পড়বে না দেশের চরম মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না সদ্য প্রকাশিত মুদ্রানীতিতে। এটা অনেকটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়াই বোঝানো হয়েছে।

এবার আসা যাক যুক্তিসংগত মূল্য স্থিতিশীলতা বিষয়ে, যা মুদ্রানীতির একটি অন্যতম লক্ষ্য। অর্থনীতিতে সর্বজনস্বীকৃত যে শক্তিশালী মুদ্রা যুক্তিসংগত মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে। কিন্তু টাকার শক্তি কতটুকু তা বাজারে গেলে প্রতিটি মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। দ্রব্যমূল্য শুধু চাহিদা ও সরবরাহের ওপরই নির্ভর না করে অর্থের প্রাপ্যতার ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। ভোক্তার আর্থিক সংগতির ওপরই দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। আবার আর্থিক সংগতি মুদ্রা সরবরাহের ওপর সরাসরি সম্পৃক্ত। এখন বিশ্বে যা মুক্তবাজার অর্থনীতি হিসেবে সুপরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত তার স্থিতিশীল মূল্য ব্যবস্থা ধরে রাখার জন্য তার মুদ্রানীতিতে যে ব্যবস্থা বা নীতি নিয়ে থাকে তা অন্য দেশের জন্য প্রযোজ্য না-ও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বাজার থেকে প্রচুর আমদানি করে থাকে। আবার বিশ্ববাজারে প্রচুর রপ্তানিও করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার বিশ্ব বাণিজ্যের এক নম্বর মুদ্রা। সে তার অব্যাহত ডলার মূল্যের মান নিয়ন্ত্রণ করে বাজারের মূল্য স্থিতিশীলতা ধরে রাখে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে বহু বছর ধরে তৈরি পোশাক আমদানি করে। কিন্তু সেই আশির দশকে যে ডলার মূল্যে তারা তৈরি পোশাক বাংলাদেশ থেকে ক্রয় করত ২০২৩ সালেও প্রায় একই মূল্যে ক্রয় করে। মাঝখান থেকে তারা তাদের ডলারের মূল্য টাকাপ্রতি ১০০ টাকার বেশি উঠিয়ে দিয়েছে। এটি তারা করেছে তাদের মূল্য স্থিতিশীলতা যুক্তিসংগত পর্যায়ে ধরে রাখার জন্য। একইভাবে ভারতও তার যুক্তিসংগত মূল্য স্থিতিশীলতা ধরে রাখার জন্য ভারতীয় মুদ্রার মান নির্ধারণের নীতি গ্রহণ করে, যা তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর অনুসরণযোগ্য যে হবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। ইচ্ছা করলেই বা নিজ উদ্যোগে কখনই বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।

বিনিময় হার স্থিতিশীলতা রাখা যে কোনো মুদ্রানীতির মূল প্রতিপাদ্য। বিভিন্ন মুদ্রার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই বিনিময় হার যে কোনো মুদ্রার শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করে। মুদ্রার বিনিময় হার একটি অতি তরল অবস্থান যা কখনই ষান্মাসিক ভিত্তিতে স্থির রাখা সম্ভব নয়। তাই বলে অতি ঘন ঘন বিনিময় হার পরিবর্তনশীল হলে মুদ্রার গ্রহণযোগ্যতা ও তার মান হারিয়ে ফেলে। কাজেই মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখার সুস্পষ্ট অবস্থান মুদ্রানীতিতে থাকতেই হবে। না হলে সুযোগসন্ধানীরা মুদ্রার বিনিময়কে একটি লাভজনক পণ্যে রূপান্তরিত করে ব্যবসায়িক ফায়দা লোটার সুযোগ পেতে পারে।

সুদের হার নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই যে কোনো মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের মুদ্রা সরবরাহের মূল উৎস। তারা দেশীয় মুদ্রা তথা টাকা ছাপায় এবং তা বাজারে ছাড়ে। সেই সঙ্গে বিদেশি মুদ্রা মজুদ ও বিতরণ করে। এই হলো মোদ্দা কথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপানোর পরে তা জনগণের কাছে বিতরণ করার জন্য ঋণ আকারে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রদান করে। অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যাংক হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাপানো টাকার বাজারজাত করার দোকান। যারা বিভিন্ন জামানতের বিনিময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দিষ্ট সুদে ধার নিয়ে ব্যবসা করে। ব্যাংক আবার জনগণের অর্থ নির্দিষ্ট শর্তে আমানত রেখে ও অন্যকে বিভিন্ন সুদে ঋণ দিতে পারে বা প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে জমা রাখতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, তাই তার সব মুদ্রা লেনদেনের একটি সুস্পষ্ট নিয়ম বা বিধিবিধান থাকতে হয়। যাকে এক কথায় বলা হয় মুদ্রানীতি। এ মুদ্রানীতির আওতায় নতুন মুদ্রানীতিতে রেপো রেট বা নীতি সুদ হার বাড়ানো হয়েছে, সেই সঙ্গে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করে, ভোক্তা ঋণের সুদ হারের সীমা শিথিল করা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো রেট ৫.৭৫% থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬% করা হয়েছে। আর রিভার্স রেপো হার আগের ৪% থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৪.২৫% করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ভোক্তা ঋণের সুদহার ৩% বাড়িয়ে ১২% করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংক আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদহার তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড ঋণের ক্ষেত্রে কোনো সীমারেখা থাকছে না। অথচ ভোক্তা ঋণ ছাড়া সব ধরনের ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশেই নির্ধারিত থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইভাবে বিশেষ রেপো হার আগের মতোই ৮% এবং ব্যাংক রেট ৪% রাখা হয়েছে। ব্যাংক রেট হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়।

সদ্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সব কিছু কেমন যেন সাংঘর্ষিক। ব্যাংকগুলো যেখানে তারল্য সংকটে ভুগছে সেখানে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি না করে রেপো রেট বাড়িয়ে তারল্য সংকট আরও বাড়িয়ে দিল। ওইদিকে একশ্রেণির বাণিজ্যিক ব্যাংক যারা ভোগ্যপণ্যে বেশি ঋণ দিয়ে আসছে তাদের অনৈতিকভাবে ৩% সুদ হার বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। তাতে ভোক্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হবে কিন্তু সেভাবে সাধারণ ভোক্তাদের আয় বৃদ্ধি পায়নি। ভোক্তা ঋণে ৩% সুদ হার বৃদ্ধি করার ফলে ভোক্তাপণ্যের চাহিদা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে যার ফলশ্রুতিতে উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং কর্মসুযোগ সংকুচিত হবে।

সেই সঙ্গে ব্যাংকে আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদ হার তুলে দেওয়ার ফলে ব্যাংকের সুদ হারও বেড়ে যেতে বাধ্য যা মূলত উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি করবে, মূল্যস্ফীতি বাড়াবে এবং বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ব্যাংকে আমানতের বেঁধে দেওয়া সুদ হার তুলে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ সুদ পছন্দ করে না এবং সুদের কামাই খেতে চায় না। একইভাবে ভোক্তা ঋণের ওপর সুদ হার বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অনৈতিক। কারণ সব ব্যাংক ভোক্তা ঋণ দেয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক বরং রেপো রেট প্রস্তাবিত ৬% থেকে কমিয়ে ২.৫% এবং বিশেষ রেপো রেটও বর্তমানের ৮% কমিয়ে ৫% করতে পারত। তাতে দেশে অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধি পেত, তারল্য সংকট দূর হতো, ঋণ প্রাপ্তি সহজতর হতো, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেত। যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত তাদের দেশীয় স্বার্থে ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় আগ্রাসীভাবে ব্যাংক রেট বাড়াচ্ছে যা কোনো অবস্থাতেই অনুসরণ করা আমাদের জন্য সঠিক হয়নি।

বেকারত্ব হ্রাস করার দিকনির্দেশনা দরকার মুদ্রানীতিতে। কিন্তু সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে প্রণীত মুদ্রানীতির মাধ্যমে কখনই বেকারত্ব হ্রাস করা সম্ভব হবে না। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব ও উচ্চ সুদ হার বেকারত্ব হ্রাসের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। খেলাপি ঋণের চেয়ে উচ্চ সুদ হার দেশের অর্থনীতিতে বেশি ক্ষতিকর। খেলাপি ঋণ ব্যাংকের আয়ের অন্তরায় কিন্তু বিনিয়োগবান্ধব এবং বেকারত্ব হ্রাসে অর্থাৎ কর্মসংস্থানে ইতিবাচক অবদান রাখে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূলত তিনটি সমস্যা। তার প্রথমটি হলো- ব্যাপক জনগোষ্ঠীর নিম্নমানের কর্মক্ষমতা। দ্বিতীয়টি হলো- পরিবর্তনশীল সম্পদের তথা শিল্পের কাঁচামালের তীব্র স্বল্পতা। তৃতীয়টি হলো- বিশাল খাদ্য খাটতি। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক তিনটি শক্তি। তার প্রথমটি হলো, বিশাল জনগোষ্ঠী। দ্বিতীয়টি হলো, ভাগ্য পরিবর্তনের তীব্র আকাক্সক্ষা তথা পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রচণ্ড অভিযোজন-প্রবণতা। তৃতীয়টি হলো, উর্বর ভূমি ও কৃষিবান্ধব প্রকৃতি ও আবহাওয়া। আমাদের এ তিনটি সম্পদকে যদি কার্যকরভাবে প্রয়োগ বা ব্যবহার করতে পারতাম তাহলে আমরা অনেক উন্নত অবস্থায় থাকতাম। যেমন আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষাদীক্ষায় পারদর্শী করে তুলতে পারতাম তাহলে তারা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের প্রধান সমস্যা তথা নিম্নমানের কর্মক্ষমতার সমস্যা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারত। সেই সঙ্গে বিশ্বের শ্রমবাজারে একটি বিশাল শক্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে যেত। আজকের বিশ্বের শ্রমবাজারে যদি আমরা আমাদের ২০ কোটি জনসংখ্যার ২০% ভাগ তথা ৪ কোটি দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারতাম তাহলে আমরা প্রতি মাসে প্রতিজন ন্যূনতম ৫০০ ডলার রেমিট্যান্স পাঠাতে পারলে মাসিক ২০ বিলিয়ন ডলার তথা বছরে ২৪০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স বাবদ আয় হতো। শুধু বিশ্বের শ্রমবাজার থেকে আয় করেই আমাদের তাবৎ সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারতাম।

আমাদের কাঁচামালের অভাবের কারণে বিশ্বের শিল্প উৎপাদনের বাজারের তীব্র প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারব না। কিন্তু তাতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। আমাদের জনগোষ্ঠী পৃথিবীর যে কোনো পরিবেশে অতি অল্প সময়ে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। তারা যে কোনো জিনিস দেখলেই নিজেরা তা বানিয়ে নিতে পারে। তাই সম্পূর্ণ যুক্ত শিল্প পণ্য আমদানি না করে বিভাজন অবস্থায় শিল্প পণ্যের অংশ আমদানি করেই বিশ্বমানের যে কোনো পণ্য তৈরি করার ক্ষমতা তারা রাখে। এই যুক্তকরণ শিল্প উৎপাদনে ততবেশি জ্বালানি ও বিদ্যুতের প্রয়োজন পড়বে না। কারণ তখন শ্রম নিবিড় প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হবে।

তৃতীয় সমস্যা অর্থাৎ তীব্র খাদ্য খাটতি যা সমাধানের জন্য রয়েছে আমাদের অতি উর্বর কৃষি জমি এবং কৃষি উৎপাদন বহুমুখীকরণ উপযোগী প্রকৃতি ও আবহাওয়া যা আধুনিক প্রযুক্তিতে কাজে লাগিয়ে কৃষি উৎপাদন অন্তত দ্বিগুণ করা যায় তাহলে শুধু খাদ্য উপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণই নয়, বিশ্বের খাদ্য রপ্তানির একটি বড় ভাণ্ডার হতে পারব আমরা। তখন বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ঘামাতে হবে না।

আমি মনে করি একমাত্র যুগোপযোগী একটি সঠিক মুদ্রানীতি দ্বারাই আমাদের মূল তিনটি সম্পদকে অতি দ্রুততা ও কার্যকরভাবে কাজে লাগিয়ে আমাদের তিনটি মূল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। এর জন্য আমাদের রেপো রেট ২%, বিশেষ রেপো রেট ২%, আমানতের সুদ হার ২% এবং ব্যাংকের সব ধরনের ঋণের সুদ হার ৫% এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে। তাহলেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে, আন্তঃব্যাংকিং প্রতিযোগিতা বাড়বে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে, সামাজিক ভারসাম্য স্থিতিশীল হবে, ধনী-দরিদ্রের ফারাক কমবে এবং সেই সঙ্গে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে ও শান্তি-শৃঙ্খলার দর্শনীয় উন্নয়ন হবে। সবচেয়ে বড় অর্জন হবে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম বৃদ্ধি পাবে ও গৌরবান্বিত আত্মপরিচয় হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর