সোমবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বইমেলা নিয়ে কিছু কথা

খান মাহবুব

সংস্কৃতি অনেক কিছুই সাঙ্গ করে বহমান থাকে মানুষের যাপিত জীবনে। চলার পথেই নানামাত্রিক তাগিদে মানুষ যুক্ত ও বিযুক্ত হয়- অনেক বিষয়, ঘটনা, অভ্যাসের সঙ্গে। নগর ও গ্রামে সংস্কৃতির তারতম্য ভেদেও বিশ্বায়নের যুগে সমাজে এককেন্দ্রিক সংস্কৃতির অনুসঙ্গ ও উপাদান অনেকাংশে বিরাজমান। এ জন্যই বাংলায় বইমেলা সর্বজনীন সংস্কৃতির অংশে রূপ নিয়েছে। বইমেলা বললেই অমর একুশে বইমেলার ক্যানভাস চকচক করে বর্ণিল হয়ে আভা ছড়ায় আমাদের মন ও মননে। আজ বইমেলা যেন ঢাকা শহরের সব অলিগলির মিলন মোহনা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষও যুক্ত হয় এ মেলায়। বইমেলা শুধু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বিকিকিনি নয়, বইমেলা বহুকেন্দ্রিক আয়োজনে আমাদের সাংস্কৃতিক জাগরণের উৎস ভূমি।

্ঐতিহ্যের পরম্পরায় ঔপনিবেশিক শাসনকে ভর করে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের দোলা লাগে আঠারো শতকে পূর্ববঙ্গে। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের পণ্য ও প্রযুক্তির প্রসারেই নগর সংস্কৃতির নানান উপলক্ষের সংযোগ ঘটায় পূর্ববঙ্গেত্ত। শাসক ও স্থানীয় এলিটদের সহযোগিতায় যশোরে ১৯৫১ সালে প্রথম ‘যশোহর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি’ যাত্রা করে। বই আন্দোলনের প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রার মোড়কীকরণ এখান থেকেও বলা যায়।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বিশ্বব্যবস্থায় পুঁজিবাদের বাঁক পরিবর্তনে নতুন যুগের আগমনী বার্তায় যুক্ত হয় শিল্পায়ন-উত্তর সমাজ। ক্রমেই তা আধুনিক সংস্কৃতির পথে পা বাড়ায়। মানুষের অভ্যাস, রুচি ও চালচিত্রে পরিবর্তন আসে। ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর মধ্যেও সৃজনমনস্ক মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে পূর্ববঙ্গে। নাট্যচর্চা, পাঠাগার আন্দোলন, সংস্কৃতি সংঘ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিতে মানুষ যুক্ত হয়। পাকিস্তানি জমানায় বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা (১৯৫৫) জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ঢাকা কেন্দ্র স্থাপন (১৯৬১) তাৎপর্যময় বিষয়। এ পথ পরিক্রমণে ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনে পূর্ববঙ্গে প্রথম বইমেলার আয়োজন হয়, যা ইতিহাসের পাঠে পেরেক ঠুকে আছে। পাকিস্তানি জমানায় স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন অগ্নিবারুদের মতো জ্বলেছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও, তবে বইমেলার খুব একটা নজির মেলে না। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে বাঙালির সাংস্কৃতিক ভুবনে নিজস্বতা ও স্বাধীনতার পাখা মেলে। দেশজ সংস্কৃতির পরিতোষণের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯৭২ সালে ইউনেস্কো ঘোষিত আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষের জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের স্বল্প পরিসরে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আন্তর্জাতিক বইমেলায় দেশীয় বইয়ের পসরা নিয়ে চিত্তরঞ্জন সাহা (মুক্তধারা প্রকাশনী), রুহুল আমিন (স্ট্যান্ডার্ড পাবলিকেশন), তাজুল ইসলাম (বর্ণমিছিল) বসেন। সেদিনের সেই অনানুষ্ঠানিক ও স্বপ্রণোদিত বই নিয়ে বসা পরবর্তীতে বর্ধিত কলেবর রেওয়াজে পরিণত হয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের বইমেলার মহিরুহের রূপ। আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একডেমির চলনে-বলনে পরিমার্জন এসেছে। বাংলা একাডেমির স্লোগানের বিবর্তনও একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয়। প্রথম পর্যায়ে স্লোগান-‘জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক।’ পরবর্তীতে ‘জাতির মননের প্রতীক’ বর্তমানে ‘বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক। বাংলা একাডেমির কর্মপরিধিতেও ২০১৩ সালে গৃহীত আইন ও সম্প্রতি সময়ের প্রবিধান প্রতিষ্ঠানের চালচিত্রের নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে বইমেলা এখন একাডেমির একটি বার্ষিক বিধিবদ্ধ কাজে রূপান্তর হয়েছে। বাঁক পরিবর্তনের বিধি ও অনুশাসনের বেড়াজালে অনেকেই মনে করেন বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে সৃজনমনস্ক মানুষের চাকরির জায়গাটা সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি বাংলা একাডেমির স্বশাসনের বিষয়টিও উপেক্ষিত হয়েছে। বইমেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান হিসেবেও গতানুগতিক ব্যবস্থার ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারছে না বাংলা একাডেমি, ফলে বিশ্বায়নের বিশ্বব্যবস্থায় বইমেলার বড় পরিসরে বিস্তার ও সংযুক্ত করার প্রবণতাও কাক্সিক্ষত মানের নয়। আমরা তো চাই বইমেলা শুধু বই বিক্রির কেন্দ্র নয়, বাঙালি সংস্কৃতি জাগরণের একটি সেন্টার ফর এক্সিলেট হিসেবে বইমেলার ক্যানভাস রচিত হবে। ২০১৪ সালে বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংযুক্ত হলে গতানুগতিক কিছু সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু এখনো বইমেলা স্টল বিন্যাস, খাবারের দোকানের বরাদ্দ, প্রবেশ গেটের সংস্থা নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে আটকে আছে। যদিও বিভিন্ন ধরনের মঞ্চ স্থাপন, মোড়ক উন্মোচন কেন্দ্র, ‘আমি লেখক বলছি’ নামীয় অনুষ্ঠানমালা লোকপ্রিয় হয়েছে।

গত কয়েক বছর বিশ্বমারি করোনা ও সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধে বইমেলার চিরায়ত রূপের বৈকল্য ঘটেছে। বইমেলায় বাণিজ্যের দিকটি উপেক্ষা করার জো নেই। আমাদের বইমেলার প্রবণতা হলো প্রকাশকদের বার্ষিক বিক্রির বড় একটা অংশ মেলার মাঠে সম্পাদিত করা। কিন্তু গত তিন বছরের পরিসংখ্যান ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমির তথ্যমতে বিক্রি ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৯-এ বিক্রি দাঁড়ায় ২০১৮ থেকে ১০% বেশি। ২০২০-ও বিক্রি ৮২ কোটি টাকায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু ২০২১-এ করোনার কারণে মেলা মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়। বই প্রকাশ কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৪০টিতে (যেখানে পূর্বতন ৫ বছরে বই প্রকাশের গড় সংখ্যা ছিল ৪ হাজারের অধিক) আর বিক্রি ৫ কোটি টাকার নিচে। যা আমাদের স্বপ্নালু চোখকে ছানাবড়া করে দিয়েছে। আমাদের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েছে। ২০২২ সালে বিক্রি ৫২ কোটি ৫০ লাখে দাঁড়ায়। যদিও এ বিক্রি কম-বেশি ১০০ কোটি টাকা হতে পারত। ২০২২-এর মেলার সমাপনী অধিবেশনে বইমেলার সদস্য সচিব জামাল আহমেদ মেলায় খাবার স্টলের সংখ্যাধিক্য, ইট বিছিয়ে মেলার রাস্তা তৈরি করতে না পারা, মেলার মাঠে টাস্কফোর্স ঠিকভাবে কাজ করতে না পারাসহ বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নেন।

বইমেলার দ্রুতি বিশ্বময় করতে একটা বড় সমস্যা আমাদের চিন্তার দৈন্যতা। এ বইমেলাকে কালচারাল অ্যাম্বাসাডর হিসেবে গ্রহণের জন্য আমাদের কর্মকৌশল প্রয়োজন। শুধু বিশ্বে সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে বেশি সময় ব্যাপ্তির বইমেলা ইত্যাদি মন্থন করে তৃপ্তির ঢেঁকুর না তুলে বইমেলার সংযোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো দরকার। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বইসহ সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় কম। উন্নয়নশীল দেশের সরকারব্যবস্থায় দৃশ্যমান উন্নয়ন তথা ইট, বালি, পাথরনির্ভর অবকাঠামোগত বিষয় প্রাধান্য পায়। বাংলাদেশও সেই রীতির বাইরে নয়। দোহাই দিয়ে বলা যায় জাতীয় বাজেটে কমবেশি ১ শতাংশের কম বরাদ্দ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য। অমর একুশে বইমেলার বাংলা একাডেমির জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ নেই। মাত্র বইমেলার ৫ কোটি টাকা বাজেট সংকুলানে বাংলা একাডেমিকে নানা ধরনের লোড ম্যানেজমেন্ট তথা প্রকাশকদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। অথচ সরকারের যেটুকু সামর্থ্য আছে তাতে এতটুকু টাকা সৃজনশীল কর্ম বিবেচনায় প্রণোদনা হিসেবে বরাদ্দে সামর্থ্যও রাখে। বইমেলা আয়োজনে অংশীজনদের অংশগ্রহণ থাকলেও তা অনেকাংশে আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বাংলা একাডেমি তাদের বিবেচনায় আয়োজনের ছক রচনা করে। এতে বহুকেন্দ্রিক চিন্তার সুফল বইমেলা খুব একটা পায় না। বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জায়গার সুবিধা নিয়ে পূর্বতন ২০২০ সালের ৮ লাখ বর্গফুটের থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ লাখ বর্গফুট করায় ২০২১ সালে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বইমেলা করোনাকালীন গত দুই বছর স্বরূপে পাখা মেলতে পারেনি। বইমেলায় উপচে পড়া মানুষের ঢল, বেচাকেনার নিম্নগতি সব যেন এক জবুথবু অবস্থা। বইমেলার মাঠে প্রাণের স্পন্দনের ছন্দপতন ঘটেছে।

২০২২ সালের বইমেলা ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্বমন্দা করোনার প্রতিঘাতকে সাঙ্গ করে এগোতে থাকে। এক্ষেত্রে কাগজ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্বিগুণ মূল্যবৃদ্ধি সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। আশ্চর্য আমাদের এ প্রিয় স্বদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট। সরকার যেন দর্শকমাত্র, সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী দুই/তিন দিনের ব্যবধানে বাজার থেকে তেল, চিনিসহ নানা পণ্য উধাও করে দেয় আবার অযাচিত মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে বাজারে ফেরত আনে। সম্প্রতি কাগজের দাম শুধু দ্বিগুণই করেনি সিন্ডিকেট, বাজার থেকে কাগজ উধাও করেও রেখেছে কয়েক দিন। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রকরা দু/একজন ছাড়া অন্য কাগজ উৎপাদকরা বাজারে থাকতে পারছে না। বিশ্বায়নের বেসরকারিকরণের পরামর্শে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের নীতির মান্যতায় আমাদের ঐতিহ্যবাহী কর্ণফুলী পেপার মিলস, নর্থবেঙ্গল পেপার মিল, পাকশী পেপার মিলকে হিমঘরে চলে যেতে হয়েছে। বৈশ্বিক অনুঘটকগুলোর প্রভাবক কাগজের কিছুটা মূল্যবৃদ্ধি হবে কিন্তু কোনো বিবেচনায় তা দ্বিগুণ নয়।

কাগজ উৎপাদনের মূল উপাদান উদ্ভিজ্জ এবং তত্ত্বযুক্ত হলেও বাংলাদেশে পুরনো কাগজ ও বর্জ্য কাগজকে পাল্পের সঙ্গে মিশিয়ে রিসাইক্লিং করে কাগজ তৈরি হয়। ফলে প্রধান উপকরণ আমদানিনির্ভর পাল্পের ওপর চাপ কম। আমদানিনির্ভরতাও প্রতিবেশী ইন্দোনেশিয়া ও কোরিয়া থেকে। ফলে কাগজের মূল্যবৃদ্ধির এ হার কাম্য নয়। কিন্তু সুযোগসন্ধানীর এ দেশে সবই সম্ভব, কাগজই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কাগজের মৃল্যবৃদ্ধি বইমেলাতে অশনিসংকেত দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বইয়ের উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশে নেমে যাবে। অনন্যার মতো বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বইমেলাতে নতুন বই প্রকাশ না করার ঘোষণা দিয়েছে। এই এক নীরব প্রতিবাদ। বাংলাদেশ যখন উন্নত জাতি-রাষ্ট্র বিনির্মাণে বিভোর তখন এসডিজির অর্থনৈতিক ও মানবিক সূচকগুলোর অগ্রায়নের ধারা সরকারের উন্নয়নের রক্ষাকবচ। কাগজসহ সামগ্রিক সৃজনশীল খাত অভিভাবকহীন। বইমেলায় এ বছর গতানুগতিকতা পরিহার করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক। পাশাপাশি অংশীজনদের সংযোগ করার সুযোগ বাংলা একাডেমিকে যেমন করে দিতে হবে, তেমনি অংশীজনদের গা-ছাড়া অবস্থা পরিহার করে মমত্ব দিয়ে সংযুক্ত হতে হবে।

বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতায় বইমেলা নিয়ে ভিন্ন আঙ্গিকে নবমাত্রায় পরিকল্পনের এখনই মোক্ষম সময়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বইমেলা মাঠে পাঠকের অপর্যাপ্ততা আমাদের পীড়া দেয়। প্রগতিশীল বাংলাদেশের আইকন এ বইমেলা। আয়োজক হিসেবে দায়দায়িত্বের চেয়েও জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির কাছে আমাদের প্রত্যাশা অভিভাবকত্বের। বইমেলার সর্পিল গতি প্রবাহে অংশীজন কুশীলবদের হাতে হাত ধরে এগিয়ে এসে মেলার চিরচেনা চরিত্রে ফিরিয়ে আনতে হবে। সর্বোপরি কাগজের দরে লাগাম টানা না গেলে বইয়ের মেলায় বইশূন্যতা দেখা দিতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর