শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঘুরে আসুন সুন্দরবন

তপন কুমার ঘোষ

ঘুরে আসুন সুন্দরবন

স্রেফ বেড়ানোর জন্য অনেকে বিদেশে যাচ্ছেন। গন্তব্য-ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর। কিন্তু দেশেও বেড়ানোর অনেক আকর্ষণীয় জায়গা আছে।  হালে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দক্ষিণের সুন্দরবন।  সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্য হাতছানি দেয় পর্যটকদের।

বিশ্বঐতিহ্য এলাকা সুন্দরবন। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। স্ন্দুরবনের কোলঘেঁষে বঙ্গোপসাগর। সাগরে জোয়ার-ভাটা হয়। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকা। আবার ভাটার টানে জেগে ওঠে। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ বন বলা হয়। মাইলের পর মাইল বিস্তৃত চিরসবুজ সুন্দরবন পর্যটকদের নজর কাড়ে। সুন্দরবনে আছে সুন্দরী, গরান, গেওয়া আর কেওড়া গাছ। এখানে নাগরিক জীবনের সেই ব্যস্ততা নেই, কোলাহল নেই, বায়ুদূষণ নেই। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক সংযোগও নেই। আছে কেবল বনের নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা। আছে যান্ত্রিক জীবন থেকে সাময়িক মুক্তি। খুলনা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য আছে পর্যটকবাহী ছোট ও মাঝারি আকারের বেশ কয়েকটি জাহাজ। খুলনার জেলখানার ঘাট থেকে এগুলো সকালের দিকে ছেড়ে যায়। দুই রাত-তিন দিনের প্যাকেজ ট্যুর। জাহাজে আছে সারি সারি কেবিন। কেবিনেই রাতযাপন। খাওয়া-দাওয়ার এলাহি আয়োজন। প্রাতঃরাশ, মধ্যাহ্নভোজন, রাতের খাবারসহ পূর্বাহ্ণে ও অপরাহ্ণে হালকা খাবার প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত। জনপ্রতি খরচ সাকুল্যে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। বিলাসবহুল জাহাজও আছে। সে ক্ষেত্রে জনপ্রতি খরচ পড়বে ২০ হাজার টাকার মতো।অতি সম্প্রতি পর্যটন জাহাজে করে সপরিবারে সুন্দরবন ঘুরে এলাম আমরা মোট ৫৭ জন। আমাদের সমন্বয়কারী মো. জাকারিয়া খুবই করিৎকর্মা লোক। জাহাজের সারেং মাস্টার মো. এনামুল সর্দার আমাদের জানালেন, সুন্দরবনের নৌপথ তার নখদর্পণে। এক যুগেরও বেশি সুন্দরবনের দুটি রুটে তিনি পর্যটকদের নিয়ে যাওয়া-আসা করছেন। একটি রুট করমজল-হাড়বাড়িয়া-কটকান্ডজামতলা সি-বিচ, হিরণ পয়েন্ট হয়ে দুবলার চর পর্যন্ত বিস্তৃত। অন্যটি কটকা থেকে কচিখালী হয়ে ডিমের চরে গিয়ে শেষ হয়েছে। এনামুল সর্দার অভয় দিয়ে বললেন, এখন আর জলদস্যুর কোনো ভয় নেই। ছোটকালে বইতে পড়েছি, ‘সুন্দরবনে জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ।’ খরস্রোতা প্রশস্ত নদীর দুই পাশে যতদূর চোখ যায় সবুজের হাতছানি। নদীতে আছে জোয়ার-ভাটা। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার জগদ্বিখ্যাত। প্রাণ হাতে করে সুন্দরবন থেকে কাঠ ও মধু সংগ্রহ করেন বাওয়ালিরা। বনের মধ্যে ঢুকে গেছে অসংখ্য খাল। মৎস্য শিকারিরা জীবনের ঝুঁঁকি নিয়ে খালে মাছ শিকার করেন। মন চাইলে সুন্দরবনের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে আসতে পারেন। সঙ্গে পাবেন দক্ষ গাইড। কর্দমাক্ত হওয়ায় এবং কাদামাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা সুন্দরী গাছের ধারালো শ্বাসমূলের কারণে সুন্দরবনে হাঁটাচলা দায়। হাঁটার জন্য আছে কাঠের পাটাতন। ক্ষুধার্ত বানর খাবারের লোভে আপনার পিছু নেবে। পর্যটন স্পটগুলোতে আছে সুউচ্চ ‘ওয়াচ টাওয়ার’। সেখান থেকে চোখে পড়বে বনের হরিণ। 

সুন্দরবনে বাঘের ভয় আছে। সাগরসংলগ্ন নদীর নোনা জল বিস্বাদ লাগে। রাত গভীর হলে পুকুরে নেমে মিষ্টি জল খেতে আসে বাঘ। জল খাওয়ার পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার গহিন অরণ্যে ফিরে যায়। কাদামাটির ওপর বাঘের পায়ের কাঁচা ছাপ দেখে বোঝা যায়, রাতের কোনো এক সময় বাঘ এসেছিল। বন বিভাগ সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্টে পুকুর খনন করে রেখেছে। দিনের বেলায় জল খেতে বা রোদ পোহাতে আসা বাঘ মামা আপনার দৃষ্টিসীমার মধ্যে এলে তো আর কথাই নেই। আপনার পয়সা ষোলআনা উসুল। 

আমাদের সঙ্গী বনরক্ষী মোস্তফা জানালেন, বাঘের বিচরণ গহিন অরণ্যে। ক্ষুধার্ত বাঘ খাদ্যের সন্ধানে নদী বা খালের পাড়ে এসে পড়লে পরিবেশ অন্যরকম হয়ে যায়। উৎকট একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে থমথমে ভাব বিরাজ করে। বাঘের গর্জনে কেঁপে ওঠে নিস্তব্ধ বন। বনরক্ষী মোস্তফা তার একটা অভিজ্ঞতার কথা আমাদের শোনালেন। একবার পর্যটকদের নিয়ে জামতলা সি-বিচ থেকে বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে জাহাজে ফিরছিলেন। কাছাকাছি কোথাও বাঘের উপস্থিতি টের পান। খানিকটা দূরে বনের মধ্যে একটা বাঘ শান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ফায়ারিং সাউন্ড করে তাড়িয়ে দেন বাঘ। মোস্তফা লক্ষ্য করলেন, শূন্যে গুলি ছোড়ার পর বাঘের কোনো হেল-দোল নেই। পেছন ফিরে একবার তাকিয়ে ধীরে-সুস্থে আপন ঠিকানায় ফিরে যায় বনের বাঘ। দুই রাত-তিন দিন সুন্দরন ভ্রমণ শেষে যেখান থেকে যাত্রা শুরু সেখানেই নামিয়ে দেবে আপনাকে ট্যুর অপারেটর। চাইলে শেষ বিকালেই রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করতে পারেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা-খুলনা রুটে চালু হয়েছে অনেক বিলাসবহুল বাস সার্ভিস। মাত্র ৪ ঘণ্টার জার্নি। পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে পাল্টে দিয়েছে দেশের দক্ষিণ জনপদের মানুষের জীবন। বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে ইউরোপ-আমেরিকার কোনো হাইওয়ে বলে ভ্রান্তি হতে পারে। এমন সড়ক বাংলাদেশ আগে কখনো দেখেনি। গর্ব করার মতোই। দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটনশিল্পের দ্বার খুলে দিয়েছে পদ্মা সেতু।  বাঙালি ‘ঘরকুনো’ বলে এক সময় অপবাদ দেওয়া হতো। সেই বদনাম এখন ঘুচে গেছে। অবকাশের দিনগুলোতে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। সামর্থ্যবানেরা ছুটছেন বিদেশে। স্বীকার করতেই হবে, বাঙালি ভ্রমণপ্রিয় জাতি। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বেড়েছে।  সেই সঙ্গে রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। প্রকৃতির সান্নিধ্যে একান্তে সময় কাটাতে চাইলে  আপনার গন্তব্য হতে পারে সুন্দরবন।

                লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা   পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর