মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

গড়ে উঠুক বইয়ের প্রতি ভালোবাসা

ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার

গড়ে উঠুক বইয়ের প্রতি ভালোবাসা

মানুষের জীবনে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কী, এ প্রশ্নের উত্তরে জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানরা বলবেন বই। বিখ্যাত লেখক প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, মানুষের জীবনে তিনটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলো হলো- বই, বই এবং বই। বই পড়েই মানুষ শিক্ষিত ও জ্ঞানী হয়ে দেশ, জাতি এবং পৃথিবী পরিচালনা করে। এ জ্ঞানের বলেই মানুষ মহাকাশে অবাধে যাতায়াত করে, সমুদ্রের তলদেশেও নির্বিঘ্নে বিচরণ করে। পৃথিবীর ইতিহাস-ঐতিহ্য ও বিবর্তন সবকিছুই বইয়ে লিপিবদ্ধ থাকে। পৃথিবীতে যত সফল ব্যক্তি আছেন তাদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসটি আছে বলেই তারা জীবনে সফল হতে পেরেছেন। তাই বই পড়ার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং উপকারিতা বলে ও লিখে শেষ করা যাবে না। বই পড়লে ১. একাগ্রতা বাড়ে ২. জ্ঞান বাড়ে ৩. কল্পনাশক্তি বাড়ে ৪. ভালো ঘুম আসে ৫. একাকিত্ব দূর করে ৬. মনে রাখার ক্ষমতা বাড়ে ৭. সর্বাত্মকভাব বিকাশ হয় ৮. লক্ষ্য পূরণে আত্মবিশ্বাস বাড়ায় ৯. শব্দভাণ্ডার বাড়াতে সাহায্য করে ইত্যাদি। তাই শত বছরের পুরনো বই সংরক্ষিত থাকে গ্রন্থাগারে, থাকে অনেকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে পরম যত্নে। অর্থাৎ বই মানুষের কাছে মহামূল্যবান ও পবিত্র সম্পদ।

প্রয়োজনীয় বইটি কিনতে বইপ্রেমীরা যায় বইয়ের দোকানে, বইমেলায়। দেশের বৃহৎ বইয়ের বাজার হচ্ছে ঢাকার বাংলাবাজার ও নীলক্ষেত। ফেব্রুয়ারি জুড়ে বাংলা একাডেমির বইমেলায় ঘটে বই ও লেখকের সবচেয়ে বড় মিলনমেলা, পরিণত হয় বইপোকাদের তীর্থস্থানে। আধুনিক বিশ্বে যতরকম মেলা হয় এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো বইমেলা। ডিসেম্বরেও দেশব্যাপী বইমেলা হয় জেলা, উপজেলা পর্যায়ে। তবে দুর্লভ ও পুরনো বই কেনার জন্য নীলক্ষেতের বিকল্প নেই। আশপাশে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইডেন কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায় শহরের বৃহত্তম বইয়ের বাজারের মুকুট বহু বছর ধরে নীলক্ষেতেরই দখলে। শুরু হয়েছিল প্রথমে ১৯৬৬ সালে। প্রথমে শুধু পাঠ্যবই দিয়ে বিক্রি শুরু হলেও ধীরে ধীরে বড় পরিসরে অন্যান্য বই বিক্রিও শুরু হয়। নতুন বইয়ের পাশাপাশি পুরনো বইয়ের বিশাল সমারোহ ঘটে ঢাকা শহরের বিভিন্ন ফুটপাতে। বাংলাবাজারের সব ফুটপাত ও মূল পয়েন্টের ফুটওভার ব্রিজের নিচ, বাবুবাজার, মিরপুর-১০, পল্টন মোড়সহ ঢাকা শহরের অসংখ্য ফুটপাতে অস্থায়ী বইয়ের দোকান দেখা যায়, যা চরম ব্যস্ত নগর জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ বলা চলে। বহু বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে জ্ঞানচর্চার এ দৃশ্য নগরটিতে। কিন্তু কোথা থেকে এলো এসব দোকান? কীভাবে এই বিপুলসংখ্যক বই সংগ্রহ করা হয় অথবা কারাই বা টিকিয়ে রেখেছে এ ব্যবসা। জানা যায়, ১৯৭৪ সালে নীলক্ষেত এলাকায় সব বস্তি ভেঙে গড়ে ওঠে বাকুশাহ ও গাউছুল আযম মার্কেট, যার পুরোটাজুড়েই লেখাপড়ার সামগ্রী, বই, খাতা-কলমের দোকান দেওয়া হয়। সময়ের পরিক্রমায় এ এলাকা বইয়ের বাজার হিসেবে এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, একটা সময় মার্কেটের জায়গা ছাড়িয়ে ফুটপাতও বইয়ের দখলে চলে যায়। নতুন বইয়ের অর্ধেক বা তার চেয়ে কম দামে এখান থেকে ক্রেতা যেমন বই কিনতে পারেন, তেমনি পুরনো বইও এখানে বিক্রি করা যায়। আবার কেজি দরে পুরনো বই সংগ্রহকারী ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে পিস হিসেবে কিনে নেন ব্যবসায়ীরা। অনেক সময় আবার পাঠক নিজেই পুরনো বই বিক্রি করতে সরাসরি ফুটপাতের পুরনো বই বিক্রেতাদের কাছে যান। সব বয়সী লোকই বই কেনেন এখান থেকে। তবে আজকাল প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে তরুণদের মধ্যে এখন কিনে বই পড়ার চেয়ে অনলাইনে পড়ার প্রবণতাই বেশি। ই-বুক এবং পিডিএফ ভার্সনের কারণে বই কিনে পড়ার অভ্যাস আগের চেয়ে অনেকাংশেই কমে আসছে। এর সঙ্গে পাইরেসি ও ফটোকপির দৌরাত্ম্যে একবিংশ শতাব্দীতে এসে ফুটপাত কিংবা বইবাজারের ব্যবসায় মন্দা দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছিল করোনাকালে। সে সময় ছিল স্কুল-কলেজ বন্ধ। উল্লেখযোগ্য হারে কমে গিয়েছিল বই বিক্রি। ফলে মহাসংকটে পড়েছিলেন বই মুদ্রণ এবং পুস্তক বিক্রেতারা, যা আজও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তারা। এর মধ্যে দেখা দিয়েছে কাগজ, কাঁচামাল ও ডলারের সংকট। ব্যবসায়িক এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ভাবনায় দিশাহারা এসব লোক। মানুষের জ্ঞানের খোরাক মিটিয়ে যারা নিজেদের পেটের খোরাক জোগান তারা আজ সীমাহীন দুর্ভোগে আছেন। এতদসত্ত্বেও অনেকটা পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি ধরে রাখার জন্যই এ ব্যবসার সঙ্গে এখনো জড়িয়ে আছেন অনেকে।

যে বই থাকার কথা লাইব্রেরিতে কিংবা গ্লাস করা এসি রুমে, সেই বই আজ ফুটপাতে। অথচ জুতা নিত্য দেখা যায় এসি করা বাহারি শোরুমে। বই আজ ফুটপাতে বৃষ্টিতে ভেজে, রোদে শুকায়, চাঁদাও দিতে হয় মাস্তানদের। কত শত মানুষ দামি জুতা পরে হেঁটে যায় এ ফুটপাত দিয়ে অথচ একবার তাকায়ও না কী আছে এ বইয়ে, কীভাবে সৃষ্টি হয় এ বই? ৪-৫ হাজার টাকা দামের জুতা পরে ফুটপাত দিয়ে বইগুলো দেখে দেখে, এলোমেলো করে রেখে চলে যায়, কিন্তু মাত্র ৫০-১০০ টাকা দিয়ে বই কিনতে মন চায় না। বই ও জুতা দুটিই মানুষের জীবনে খুব দরকারি। প্রতিটি মানুষের জীবনে জুতা লাগলেও বই না-ও লাগতে পারে। তবু বইয়ের মর্যাদা ও স্থান মনের গভীরে, মাথার ওপরে, আর জুতা থাকে পায়ের তলায়। আমাদের বিবেক জাগ্রত হোক, জাগ্রত হোক জ্ঞানপিপাসুদের মনের দরজা। বইয়ের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা বিবেকবান লোকের পবিত্র কর্তব্য। এ শিল্পের সামান্য ক্ষতি হওয়া মানে বই ও ইতিহাস সৃষ্টিতে স্তব্ধতা নেমে আসা, পৃথিবীতে অন্ধকার ডেকে আনা। তাই বই ব্যবসায়ী, মুদ্রণ শিল্প ও শ্রমিকদের বেঁচে থাকার কথা একটু ভাবি। তাদের দেওয়া হোক আর্থিক সহায়তা, গঠন করা হোক কল্যাণ বোর্ড, সুদৃষ্টি পড়ুক রাষ্ট্রের।

লেখক : অধ্যাপক এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর