সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

ভারত মহাসাগর

আবদুর রশিদ

ভারত মহাসাগর

ভারত মহাসাগর পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। চার মহাদেশ জুড়ে এ মহাসাগরের অবস্থান। উত্তরে ভারত, পাকিস্তান ও ইরান; পশ্চিমে আবর উপদ্বীপ ও আফ্রিকা; পূর্বে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়ার সুন্দা দ্বীপ ও অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণে অ্যান্টার্কটিকা দ্বারা আবদ্ধ এই মহাসাগরের আয়তন প্রায় ৭৩,৪২৭০০০ বর্গ কি.মি.। এই আয়তন পৃথিবীর মোট মহাসাগরীয় আয়তনের প্রায় ২০ ভাগ। মালয় দ্বীপপুঞ্জ ও অস্ট্রেলিয়া-অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের মধ্যবর্তী স্থানের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরকে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে সাধারণভাবে পৃথক করা যায়। অন্যদিকে, আফ্রিকা ও অ্যান্টার্কটিকার মধ্যবর্তী বিস্তৃত এলাকা এবং সুয়েজ খালের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরকে আটলান্টিক মহাসাগর থেকে আলাদা করা যায়। আরব সাগর বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর ভারত মহাসাগরের প্রধান তিনটি বাহু।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এইচএমএস-‘চ্যালেঞ্জার’ এবং জার্মানির ‘গ্যাজেল’ ও ‘ভলদিভিয়া’ নামক জাহাজসমূহের অভিযান থেকে ভারত মহাসাগরের তলদেশের ভূসংস্থান সম্পর্কিত তথ্যাদি পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ‘সিলার্ক’সহ আরও অনেক ব্রিটিশ বৈদ্যুতিক তার সহযোগে বার্তা প্রেরণ সুবিধাসহ জাহাজের অনুসন্ধান তৎপরতার ফলে প্রাপ্ত তথ্যাদি আরও সমৃদ্ধ হয়। ১৯২৯ সালের শুরুর দিকে ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাংশে ডিসকভারিও ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। সমুদ্র অনুসন্ধানকার্যে নিয়োজিত আরও দুটি জাহাজ মহাসাগরের উন্মুক্ত অংশে গবেষণাকার্য পরিচালনা করে। ১৯৫১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারত হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ভারত মহাসাগরের গভীরতর স্থান নির্বাচন করে অনুসন্ধানকর্ম পরিচালনা করে ডেনিশ জাহাজ Galathea। ভারত মহাসাগর নিয়ে গবেষণা ও অনুসন্ধানকার্য এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অব ওশেনোগ্রাফি এবং যুক্তরাষ্ট্রের উডসহোল ওশেনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশন সক্রিয়ভাবে ভারত মহাসাগরের ওপর গবেষণাকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। মেসোজোয়িক ও সেনোজোয়িক মহাকালে যখন গন্ডোয়ানাল্যান্ড ভেঙে যেতে শুরু করে তখন থেকেই ভারত মহাসাগরের সৃষ্টি। তবে বর্তমানকালে ভারত মহাসাগরের মহাদেশীয় সোপান অংশ সংকীর্ণ। মধ্য ভারতীয় শৈলশিরা নামে একটি অনুদৈর্ঘ্য মধ্য মহাসাগরীয় শৈলশিরা প্রায় একটানা ৩,০৪৮ মিটার গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত। ভারত থেকে অ্যান্টার্কটিকা পর্যন্ত বিস্তৃত এই শৈলশিরাটি পশ্চিম ভারতীয় এবং পূর্ব ভারতীয় খাদদ্বয়কে পৃথক করে রেখেছে। এই শৈলশিরা আটলান্টিক মহাসাগরীয় শৈলশিরার মতোই সমরূপ তবে এটি অধিকতর প্রশস্ত এবং জলরাশির ওপরিতলের খুব কাছাকাছি পর্যন্ত পৌঁছায় না। ভারত মহাসাগরের সর্বোচ্চ গভীরতা (৭,৭২৫ মি) ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের দক্ষিণে অবস্থিত জাভা খাতে। পৃথিবীর কয়েকটি বিখ্যাত এবং বৃহৎ নদীপ্রবাহ ভারত মহাসাগরে এসে পতিত হয়েছে। জাম্বেসি নদী, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিসের মিলিত প্রবাহ শাত-এল-আরব, সিন্ধু নদী, গঙ্গা নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ এবং ইরাবতী নদী এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। মাদাগাস্কার ও শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দুটি বৃহত্তম দ্বীপ যারা ভূ-গঠনগত দিক থেকে মহাদেশেরই অংশবিশেষ। লক্ষ্যাদ্বীপ, মালদ্বীপ ও চ্যাগোস দ্বীপসমূহ ভারতীয় শৈলশিরার কেন্দ্রভাগ থেকে উদীয়মান এবং দ্বীপ তিনটি বর্তমানে প্রবাল দ্বীপে পরিণত হয়েছে। সিসিলি থেকে মরিশাস পর্যন্ত বিস্তৃত ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহ ভারতীয় শৈলশিরার পশ্চিমমুখী সম্প্রসারণকেই নির্দেশ করছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ, সিসিলি দ্বীপ ও কেরগুয়েলেন দ্বীপপুঞ্জসমূহ নিমজ্জিত শৈলশিরার উন্মুক্ত চূড়া। মরিশাস ও সেন্ট পল দ্বীপ দুটি সামুদ্রিক অগ্ন্যুৎপাত থেকে সৃষ্ট। মহাসাগরের ক্রান্তীয় অংশে রয়েছে প্রবাল প্রাচীরের উপস্থিতি।

৫০০ দক্ষিণ অক্ষাংশের উত্তরভাগে অবস্থিত ভারত মহাসাগরের বেশির ভাগ অংশজুড়ে প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে গ্লোবিজেরিনা উজ। অন্যদিকে, ৪৮৭৭ মিটারের অধিক গভীরতায় সাগরের তলদেশে বিছিয়ে রয়েছে লোহিত বর্ণের কর্দম। কিছু কিছু গভীরতর অববাহিকায় রেডিওলারিয়ান উজের উপস্থিতি একটি সাধারণ ঘটনা। আবার উচ্চতর দক্ষিণ অক্ষাংশীয় মহাসাগর অংশজুড়ে ডায়াটম উজের উপস্থিতিও রয়েছে। পারস্য উপসাগরের চারপাশজুড়ে এবং ক্রান্তীয় অক্ষাংশীয় অঞ্চলে চুনযুক্ত পললের প্রাধান্য রয়েছে। তবে আফ্রিকান উপকূলে রয়েছে গ্লুকোনাইট সমৃদ্ধ পললের প্রাচুর্য।

ভারত মহাসাগরের রয়েছে দুই প্রকার পানি প্রবাহ ব্যবস্থা-ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘূর্ণায়মান একটি নিয়ত দক্ষিণমুখী প্রবাহ ব্যবস্থা (দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত, মোজাম্বিক স্রোত, পশ্চিমমুখী প্রবাহ, পশ্চিম অস্ট্রেলীয় স্রোত) এবং মৌসুমি বায়ুতাড়িত উত্তরমুখী প্রবাহ ব্যবস্থা। মহাসাগরের উত্তরাংশে পৃষ্ঠ স্রোত মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারত মহাসাগর থেকে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প বহন করে আনে এবং এই জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ুর প্রভাবে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়ে থাকে। ভারত মহাসাগরে পৃষ্ঠপানি নিষ্কাশনের ফলে কোনো বড় ধরনের গভীর পানির সৃষ্টি হয় না। কিন্তু গভীর অববাহিকার পানি সাধারণত আফ্রিকার দক্ষিণ দিক থেকে আসে। ভারত মহাসাগরে ওপরিভাগে পানির গড় তাপমাত্রা মহাসাগরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন হয়ে থাকে। সচরাচর দক্ষিণের ক্রান্তীয় অংশের উত্তরে ২০ ডিগ্রি সে, নিরক্ষীয় অক্ষাংশসমূহে ২৫ ডিগ্রি সে, পূর্ব অর্ধভাগে ২৭.৫ ডিগ্রি সে, লোহিত সাগর-পারস্য উপসাগর অংশে ৩০ ডিগ্রি সে এবং একেবারে দক্ষিণে কেরগুয়েলেন দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি ২ ডিগ্রি সে তাপমাত্রা বিরাজ করে।

আরব সাগর ও দক্ষিণ-পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বলয় বরাবর ভারত মহাসাগরের ওপরিভাগের পানি সবচেয়ে লবণাক্ত।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর