সোমবার, ২০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

প্রযুক্তির বিকৃত ব্যবহার ধ্বংস করছে পারিবারিক বন্ধন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

প্রযুক্তির বিকৃত ব্যবহার ধ্বংস করছে পারিবারিক বন্ধন

পুঁজিবাদী বিশ্বে ভোগই শেষ কথা। যে যত ভোগী সে তত সুখী-এ দর্শনে চলছে বিশ্ব। তাই তো আধুনিক বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার সবই মানুষের ভোগ ও আরামকে কেন্দ্র করে। মানুষের দেহ যন্ত্রকে আরও অকার্যকর করে দেওয়াই বুঝি আজকের বিজ্ঞানের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। সিঁড়ির বদলে আমরা ব্যবহার করি লিফট। উঠে দাঁড়িয়ে থাকলেই হলো। ৫০ তলা ১০০ তলা পর্যন্ত আপনাকে যন্ত্র টেনে তুলবে জাদুর মতো। একটা সময় ছিল আমরা পরিবারের সবার সঙ্গে একত্র হতাম। সন্ধ্যায় আড্ডা জমতো। পারিবারিক খেলাধুলায় অংশ নিতাম। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা-মমতা বৃদ্ধি পায় তো এভাবেই। কিন্তু আজ কী হলো! অভিশপ্ত মোবাইল এসে আমাদের শান্তি-সুখ কেড়ে নিয়েছে দানবের মতো। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে শুয়ে থেকেও দুজন কত দূর। একজন মোবাইল হাতে রূপচর্চার লাইভ দেখছে। অন্যদিকে ফিরে আরেকজন ভ্রমণবিষয়ক ভিডিও দেখছে। এভাবে কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা, রাতের পর রাত। স্বামী-স্ত্রীর আত্মিক-মানবিক সম্পর্কের খোলস ধীরে ধীরে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। একই দৃশ্য দেখা যায় মা-সন্তানের বেলায়ও। সন্তান চায় মায়ের সঙ্গ। মা ধরিয়ে দেয় মোবাইল। বাচ্চাকে কার্টুন ধরিয়ে দিয়ে নিজেও মজে যান মোবাইল নামক ভয়ংকর নেশায়। অনেক মা বলেন, বাচ্চা খেতে চায় না, মোবাইল দিলে খায়। আমি তাদের বলি, বাচ্চা তো মোবাইল চায় না। বাচ্চা চায়, কেউ তার সঙ্গে কথা বলুক। গল্প করুক। তার মতো করে তাকে বুঝুক। আমাদের মায়েরা আমাদের গল্প শুনিয়ে খাওয়াত। গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াত। এখনকার মায়েরা তো তা করেন না। ফলে হতভাগা শিশুর মোবাইল দেখে খাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আসলে বিজ্ঞানের কোনো দোষ নেই। সমস্যা হলো আমরা যারা ব্যবহারকারী তাদের বিকৃত মানসিকতা। কিছু দিন আগে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অনেক মানুষ হতাহতের ঘটনা ঘটে। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, আহতরা সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করছিলেন আর উপস্থিতরা সে দৃশ্য ভিডিও ধারণে ব্যস্ত ছিলেন। এ হলো আমাদের বিকৃত মানসিকতার জলজ্যান্ত উদাহরণ। বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কারই মানব কল্যাণে। বিজ্ঞান লিফট আবিষ্কার করেছে, গাড়ি আবিষ্কার করেছে, ওয়াশিং মেশিন আবিষ্কার করেছে, তার মানে বিজ্ঞান তো বলেনি তুমি শারীরিক পরিশ্রম বন্ধ করে দাও। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের মাধ্যমে একসঙ্গে অনেক কাজ করা যায়। কিন্তু আমরা এতটাই অলস হয়ে পড়েছি যে, এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা সবাই একযোগে বলছেন, বর্তমান বিশ্বের প্রায় শতভাগ রোগের কারণ কায়িক পরিশ্রম না করা। যে যত বেশি কায়িক পরিশ্রম করে, সে ততবেশি রোগমুক্ত জীবনযাপন করে থাকে।

বলছিলাম, প্রযুক্তির বিকৃত ব্যবহারে আমাদের পারিবারিক বন্ধন ক্ষীণ হয়ে আসছে। একই ঘরে থেকেও পরিবারের একেকজন সদস্য দূর-দূরান্তের মানুষের মতো বসবাস করছি। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের যোগাযোগ হয় না, ভাইবোনের সঙ্গে খুনসুটি ঘটে না, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা তো কবেই উঠে গেছে। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি। এ থেকে উত্তরণের জন্য রসুল (সা.)-এর আদর্শে ফিরে আসতে হবে। আমাদের জোরালোভাবে বলতে হবে, জীবন কেবল মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকার মতো অনর্থক কাজে ব্যয় করার জন্য আল্লাহ দেননি। আল্লাহ জীবন দিয়েছেন পরিবার, সমাজ, দেশ সর্বোপরি বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য উৎসর্গ করতে। কিন্তু আজ মোবাইল এসে, সামাজিক নামের অসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এসে আমাদের সে মহৎ জীবনের প্রেরণা ভুলিয়ে দিয়েছে। শেষ করছি রসুল (সা.)-এর দুটি হাদিস শুনিয়ে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমার মা, তোমার বাবা, তোমার ভাই-বোন, তোমার মুক্ত করা দাস, তোমার নিকটাত্মীয়- এরা সবাই তোমার সহমর্মিতার হকদার। তোমার কর্তব্য হলো, এসব আত্মীয়ের প্রতি মনোযোগী হবে, যেকোনো বিনিময়ে এদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে’ (আবু দাউদ)। আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে যে কেবল আত্মীয়রাই লাভবান হবেন, তা নয়। বরং লাভ আপনারই। এটা আমার কথা নয় বরং জগতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক রসুল (সা.) এর কথা।  আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বণির্ত, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘স্বজন-পরিজন ও সুজনের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষাকারীর আয়ু যেমন বাড়ে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সম্পদ-উপার্জনও’ (বুখারি ও মুসলিম)।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি। পীরসাহেব, আউলিয়ানগর

সর্বশেষ খবর