শুক্রবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস

আজিজ আহমদ ভূঞা

আজ ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। প্রতি বছরের মতো এ বছরও দিবসটি দেশব্যাপী যথেষ্ট উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে পালিত হচ্ছে। আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী জনগণকে আইনগত সহায়তা প্রদানকল্পে সরকার ২০০০ সালের ২৬ জানুয়ারি আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করে। একটি আদর্শ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল দর্শন হলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবারই অধিকার সমান। ধর্ম, বর্ণ কিংবা আর্থিক অসংগতির কারণে কাউকে তার বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। কিন্তু আর্থিক সংগতি সবার সমান থাকে না। ফলে দরিদ্র মানুষ যখন আইনের আশ্রয় নিতে পারে না তখন তাকে অর্থাৎ অসহায় ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেওয়া হয়। বিচার প্রক্রিয়ার যে কোনো স্তরে কিংবা বিচার প্রক্রিয়ার আগে বা পরে কাউকে আইনি বিষয়ে প্রয়োজনীয় যে কোনো সহায়তা দেওয়াকে আইনগত সহায়তা বলা যায়। আইনগত সহায়তার মূল বিষয় হলো অসহায়, দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে আইনগতভাবে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে বিচার লাভের সুযোগ করে দেওয়া। নাগরিকদের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অর্থের অভাবে কেউ যদি তার বৈধ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় অথবা আইনের আশ্রয় না পায় তবে তার অন্য সব মৌলিক চাহিদাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়ে। কাজেই আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার হলো অন্যান্য মৌলিক চাহিদার সম্পূরক একটি অধিকার। আইনগত সহায়তা সামাজিক ন্যায়বিচারের পথকে সুগম করে দেয়। গরিব ও নিঃস্ব মানুষ যাতে আইনের আশ্রয় লাভের জন্য আদালত পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারে তার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হয়। মূলত এ জন্যই আইনগত সহায়তার সৃষ্টি। গরিব, নিঃস্ব, অসহায় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যারা আর্থিক কিংবা অন্যান্য আর্থ-সামাজিক কারণে আইনের আশ্রয় নিতে অক্ষম, তাদের সরকারি আইনি সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে আইনের আশ্রয় লাভের সুযোগ করে দেয়। জনহিতকর কাজের মধ্য দিয়ে সমাজের কল্যাণ সাধন করা রাষ্ট্রের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আইনগত সহায়তা কার্যক্রম একটি জনকল্যাণমূলক সামাজিক কর্মসূচি। আইন কখনো মানুষে মানুষে বৈষম্যকে সমর্থন করে না। পৃথিবীর সব মানবাধিকার দলিলে আইনগত সহায়তা পাওয়ার অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১২১৫ সালে রচিত ম্যাগনা কার্টার ৩৯ এবং ৪০ অনুচ্ছেদে, ১৯৪৮ সালে প্রণীত মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার ৭, ৮ ও ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে, ১৯৬৬ সালে গৃহীত নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে, ১৯৮৬ সালে গৃহীত মানবাধিকার বিষয়ক আফ্রিকান সনদের ৩ এবং ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে, ১৯৫০ সালে গৃহীত ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে আইনগত সহায়তা, সমতা ও সুবিচারকে মানবাধিকার হিসেবে স্পষ্টভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সংবিধানেই সমতা ও বিচার প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ আর্থিক অভাবের কারণে কোনো নাগরিক আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন না-এটি কোনোভাবেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যদি আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়, তবে সংবিধানে বর্ণিত আইনের শাসন, সমতা, মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের বিধান অর্থহীন হয়ে পড়বে। সে জন্যই গরিব, অসহায় ও নিঃস্ব মানুষ যেন আইনি প্রতিকার পেতে পারে ও আইনজীবী নিয়োগ করতে পারে, মামলা পরিচালনার খরচ নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে পেতে পারে সে জন্যই রয়েছে আইনগত সহায়তা।

‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’-এর আওতায় সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সরকার একই বছর ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’ নামে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ওই সংস্থার অধীনে ইতোমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলায় জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির পাশাপাশি সারা দেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। বর্তমানে ওই সংস্থার তত্ত্বাবধানে সুপ্রিম কোর্ট কমিটি, জেলা কমিটি, উপজেলা কমিটি এবং ইউনিয়ন কমিটি আইনগত সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রম আদালত ও চৌকি আদালতগুলোতেও সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। প্রত্যেক জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে জেলা লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন করা হয়েছে। ‘লিগ্যাল এইড অফিস’কে আরও কার্যকর, গতিশীল ও সেবাবান্ধব করার লক্ষ্যে প্রত্যেক জেলায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ/সহকারী জজ পদমর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণকে প্রেষণে) পদায়ন করা হয়েছে। জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারগণ আইনগত সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি বিনামূল্যে আইনগত পরামর্শ প্রদান করেন এবং পক্ষগণের মধ্যকার বিরোধ বা মামলা বিকল্প পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি করে থাকেন।

ইতোপূর্বে সরকার আইনি সহায়তা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র বিচার প্রার্থীদের প্যানেল আইনজীবীর মাধ্যমে শুধু মামলা মোকদ্দমা দায়ের ও পরিচালনায় সহায়তা দেওয়া হতো এবং সরকারি তহবিল থেকে প্যানেল আইনজীবীদের ফি পরিশোধ করা হতো। এ আইনের আওতায় আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি বলতে যার বার্ষিক গড় আয় ১ লাখ টাকার অধিক নয়, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে কোনো মোকদ্দমার কোনো পক্ষ যার বার্ষিক গড় আয় দেড় লাখ টাকার অধিক নয়, মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে যার বার্ষিক গড় আয় দেড় লাখ টাকার অধিক নয় এমন ব্যক্তি। আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি ছাড়াও কর্মক্ষম নহে বা আংশিক কর্মক্ষম বা কর্মহীন ব্যক্তি, অসহায় বৃদ্ধ, কোনো শিশু, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা নারী, এসিডদগ্ধ নারী ও শিশু, মানবপাচারের শিকার ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মাতা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বিনা বিচারে কারাগারে আটক ব্যক্তিসহ নানা আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার পেতে অক্ষম ব্যক্তি এই কার্যক্রমের অধীনে আইনগত সহায়তা পাবেন। অর্থাৎ আইনগত খরচে আইনি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্র অত্যন্ত বিস্তৃত রাখা হয়েছে যাতে অধিক সংখ্যক ব্যক্তি এর আওতায় আসতে পারেন।

লেখক : সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং চেয়ারম্যান, জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি, চট্টগ্রাম

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর