সোমবার, ২২ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

কমিউনিটি ক্লিনিক বিশ্ব মডেল শেখ হাসিনা বিশ্বনেতা

অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী

কমিউনিটি ক্লিনিক বিশ্ব মডেল শেখ হাসিনা বিশ্বনেতা

জাতিসংঘে ‘কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা : সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি’ শিরোনামের ঐতিহাসিক রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক মডেল প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠায় দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার অসামান্য উদ্ভাবনী নেতৃত্বকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

দার্শনিক রাষ্ট্রনায়ক আমাকে কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি করেছেন। রাষ্ট্রনায়কের একটি দর্শন বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি আমার ওপর ন্যস্ত করেছেন তাঁর একজন কর্মী হিসেবে। আমিও তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কমিউনিটি ক্লিনিকের নেতৃত্ব দিয়েছি। বিভিন্ন সময় সুবিধা-অসুবিধায় তাঁকে পাশে পেয়েছি। আমিই বোধহয় একমাত্র ভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি দার্শনিক শেখ হাসিনার দর্শন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়েছি। কারণ, কোনো জিনিস না বুঝলে তাঁর পরবর্তী নির্দেশ পেতেও আমার অসুবিধা হয়নি। কাজে কোনো বাধা এলে সেটিও তিনি দেখেছেন। একজন দার্শনিক হিসেবে তাঁর দর্শনের ছাতা নিয়ে সব সময় তিনি কমিউনিটি ক্লিনিকের পাশে ছিলেন বলেই আজ এই স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হয়েছে। দার্শনিক শেখ হাসিনার এমন আরও অনেক অর্জন রয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য শুধুই দেশের এবং দেশের মানুষের উন্নয়ন।

সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া। বঙ্গবন্ধুই স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় অর্থাৎ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মাত্র তিন বছরেই তিনি প্রতিটি থানায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’। চালু করেছিলেন ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকেও হত্যা করেছিল। এরপর ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করলেন। তিনি কিন্তু একটি দর্শন নিয়েই দেশে এসেছিলেন। দেশে এসে তিনি দল সুসংগঠিত করলেন এবং ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন। ক্ষমতায় এসেই বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ ভেঙেচুরে দেওয়া হয়েছিল সেই আদর্শকে তিনি শুধু জোড়া লাগালেন না, সেটিকে বুকে ধারণ করলেন এবং একে একে বঙ্গবন্ধুর অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে নেমে পড়লেন।

১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর পরই বঙ্গবন্ধুকন্যা পিতার স্বপ্ন ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা’ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। জন্ম দেন উদ্ভাবনী ধারণা কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে মোট ১৪ হাজার ৪৯০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা গ্রামে ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু হয়। ২০০১ সালের মধ্যেই ১০ হাজার ৭২৩টি অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু করা হয়।

প্রশ্ন ওঠে, কমিউনিটি ক্লিনিকের দার্শনিক ভিত্তি কী? কমিউনিটি ক্লিনিককে যদি সাদা চোখে দেখা হয় তাহলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে এর মাধ্যমে দার্শনিক শেখ হাসিনা দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে চিকিৎসাসেবার আওতায় নিয়ে এলেন। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সংবিধানেও বলে গিয়েছিলেন যে, কোনো একটি লোকও যেন চিকিৎসাসেবার বাইরে না থাকে। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সেটি বাস্তবায়ন করলেন।

উনি দেখলেন, যেভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো চলছে তার মাধ্যমে সবার জন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। তাই তিনি এমন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেন যেন ২৫ মিনিটের মধ্যে মানুষ চিকিৎসাসেবা পেতে পারে। পাশাপাশি চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে কী কী খেলে তার নিউট্রেশন বাড়বে, হাঁটলে যে অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এবং প্রাথমিক অবস্থায় এলে যে তাদের সামান্য ওষুধেই ভালো করা যাবে এসব বিষয়ে অবগত করবে। আর যেটি তাদের সীমারেখার বাইরে সেটি তারা রেফার করবে। এই রেফারের সিস্টেমটা যেন সঠিক হয় সে জন্য উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

দার্শনিক শেখ হাসিনা কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে বাল্যবিয়েও রোধ করেছেন। কমিউনিটি ক্লিনিকে হেলথ ওয়ার্কার হিসেবে চাকরির ব্যবস্থা হওয়ার ফলে অনেক মেয়েই বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে এবং স্বাবলম্বী হয়েছে। ফলে দেখা গেছে স্কুলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। দার্শনিক চাইলেই মাইক্রো ক্রেডিটের মাধ্যমে তাদের সাহায্য দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি যেহেতু গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ, সেহেতু তিনি বুঝতে পারেন যে গ্রামের একটা মেয়ের স্বামীর বাড়িতে কী পরিস্থিতি থাকে। তাই তিনি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে তাদের শুধু আর্থিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও মর্যাদাসীন করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের একটা ভিত্তি স্থাপন করলেন। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা বিশ্বে একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন দার্শনিক শেখ হাসিনা। চিকিৎসাব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে তিনি শান্তি স্থাপনের যে নজির তিনি সৃষ্টি করেছেন তা পৃথিবীর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। তাঁর এই মডেল বিশ্বের সব দেশেই প্রযোজ্য। যার জন্য ৭০টি দেশ রেজুলেশনের সঙ্গে কো-স্পন্সর হয়েছে। জাতিসংঘ এখন অন্যান্য দেশকেও এই মডেলের অনুকরণে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনে উৎসাহিত করছে।

জন্মনিবন্ধন, জন্মনিয়ন্ত্রণ, নারীদের প্রসবকালীন জটিলতা নিরসন, নবজাতকের পরিচর্যা, যত্ন ও লালন-পালনবিষয়ক বিভিন্ন শিক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি ক্লিনিকের ফলে এখন অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থানীয়দের মধ্যে দায়িত্ববোধ, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা সৃষ্টিতে অবদান রাখছে। স্থানীয়রা নিজেরাই কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য জায়গা দিচ্ছে, কমিউনিটি ক্লিনিক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিভিন্ন দায়-দায়িত্ব পালন করছে। এতে সমাজের মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও সামাজিক বন্ধন সৃষ্টির প্রবণতা তৈরি হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক ঘিরে সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলমত নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে ঐক্য ও সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে ওঠে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত হয়।

এভাবেই কমিউনিটি ক্লিনিক গঠন করার মাধ্যমে গণতন্ত্রের ভিত্তি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন করলেন এবং একে অপরের সঙ্গে মিলে কাজ করা যায় সেটা তিনি প্রমাণ করলেন। অর্থাৎ তাঁর একটি বাড়ি একটি খামার, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এসবকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। এ কারণেই আমি বলব দার্শনিক শেখ হাসিনার দর্শন এখন দেশের সীমারেখার বাইরে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু দেশ কমিউনিটি ক্লিনিকের মডেল অনুসরণ করছে, যা জাতিসংঘও জানে। তারপর জাতিসংঘ এটা রেজুলেশন আকারে বলে দিল। এখানেই অন্যদের সঙ্গে শেখ হাসিনার পার্থক্য। তিনি তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে একই সঙ্গে সার্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা করলেন এবং সমাজে সাম্য স্থাপন করলেন এবং গরিব আর ধনীর যে পার্থক্য সেটিও কমে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন স্মার্ট বাংলাদেশের ঘোষণা দিয়েছেন। স্মার্ট বাংলাদেশের ভিত্তি হতে পারে কমিউনিটি ক্লিনিক। আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে স্মার্ট করার উদ্যোগ নিয়েছি।

স্মার্ট কমিউনিটি ক্লিনিক মানেই স্মার্ট গ্রাম। আর স্মার্ট গ্রাম মানেই স্মার্ট বাংলাদেশ। কমিউনিটি ক্লিনিকের হাত ধরেই স্মার্ট বাংলাদেশ পূর্ণতা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : সাবেক উপদেষ্টা, চেয়ারম্যান, বিএমআরসি

ইমেইল :[email protected]

 

সর্বশেষ খবর