মঙ্গলবার, ৩০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রপতি জিয়ার বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধানী অভিযান

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন 

রাষ্ট্রপতি জিয়ার বঙ্গোপসাগরে অনুসন্ধানী অভিযান

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাবমূর্তি নষ্ট করার হীন উদ্দেশ্যে তাঁর জীবনকর্ম নিয়ে অসত্য, ভিত্তিহীন ও মনগড়া প্রচারণা চালিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। দেশের একটি মহল  মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান, তৎকালীন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিভোল্ট, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে  ঘোষণা এবং ৭ নভেম্বরে সিপাহি -জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের সংবিধান, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানকে স্বীকৃতি দিতে চায় না। দেশ বিনির্মাণে যেসব ক্ষেত্রে জিয়া সফল হয়েছিলেন, দেশের একটি বিশেষ মহল সেসব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল। এসব ব্যর্থতা ধামাচাপা দেওয়ার লক্ষ্যে তাঁর সম্পর্কে বহু বানোয়াট তথ্য অপপ্রচার করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাঁকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা ঐতিহাসিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

সম্প্রতি হাজিদের বহনকারী জাহাজ ‘হিজবুল বাহার’কে রাষ্ট্রপতি জিয়া প্রমোদতরি বানিয়েছিলেন বলে মনগড়া গল্প প্রচার করা হয়েছে। প্রমোদতরি বানানোর গল্পের সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার কোনো মিল নেই। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের সেরা একদল বিজ্ঞানী ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রগামী যাত্রীবাহী জাহাজ হিজবুল বাহারে চড়ে বঙ্গোপসাগরে একটি ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষাসফর তথা সমুদ্র অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনা ও উদ্যোগে ‘সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ এ শিক্ষাসফরের আয়োজন করে। এ সমুদ্র অভিযান বা শিক্ষাসফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুটি। প্রথমত, দেশের সেরা ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ অথচ অপরিচিত বঙ্গোপসাগরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ও সম্ভাবনা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবহিত করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল সমুদ্রবিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত গবেষণা কাজে সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া। যাত্রীবাহী হিজবুল বাহার ছাড়াও সামুদ্রিক অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ নৌবাহিনীর চারটি জাহাজ এ সমুদ্র অভিযানে অংশগ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাজারো কাজের মধ্যে এ কর্মসূচি ছিল একটি ক্ষুদ্র অথচ দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কসুলভ গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি।

রাষ্ট্রপতি জিয়ার বিজ্ঞানীদের এবং সেরা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে দুই রাত এক দিন বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করার ঘটনা নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক কৌতূহলের সৃষ্টি হয়। তখন পত্রপত্রিকার বড় শিরোনাম দখল করে এ কার্যক্রমটি। আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকের কাছে প্রশ্ন ছিল, অভিযানটি যদি সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের গবেষণা কাজের জন্য হয়ে থাকে তাহলে দেশের সেরা ছাত্রছাত্রীরা কেন এত বড় হিজবুল বাহার জাহাজে করে বঙ্গোপসাগর গেলেন? রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের এতসব কাজকর্ম রেখে কেনই বা দুই রাত এক দিন বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করলেন? অনেক সমালোচক এ আয়োজনকে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়ার ‘পিকনিক’ অনুষ্ঠান বলেও মন্তব্য করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এ আয়োজনের পেছনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার কী যে সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও লক্ষ্য ছিল তার বিশ্লেষণ করার জন্য এত বছর পর হিজবুল বাহার সমুদ্র অভিযানের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে কলাম লেখার তাগিদ অনুভব করলাম।

রাষ্ট্রপতি জিয়ার আগ্রহ ও নির্দেশে সরকার সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, শিপিং মন্ত্রণালয়, মৎস্য অধিদফতর, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, পেট্রোবাংলা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিনিধির সমন্বয়ে ‘জাতীয় কমিটি’ গঠন করেছিলেন। আলোচিত এ অভিযানের আগে একটি অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। দ্বিতীয় অভিযানটি রাষ্ট্রপতি জিয়া ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের কারণে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ অভিযানে যে হিজবুল বাহার ব্যবহৃত হয়েছিল এটি সমুদ্রপথে যাত্রীবাহী একটি জাহাজ। অতীতে বাংলাদেশ থেকে এ জাহাজে চট্টগ্রাম-জেদ্দা-চট্টগ্রাম সমুদ্রপথে হাজিদের পরিবহন করা হতো। আকাশপথে হাজিদের ভ্রমণ নাগালের মধ্যে এসে যাওয়ায় ১৯৮১ সালের কয়েক বছর আগে থেকে জাহাজটি কার্যত অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল। বিক্রি করে দেওয়ার আগ পর্যন্ত জাহাজটি সচল রাখার জন্য প্রতি তিন মাসে একবার বঙ্গোপসাগরে নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত চালাতে হতো। এ জাহাজ ব্যবহারে অতিরিক্ত খরচ যাতে না হয় সেজন্য আলোচিত সমুদ্র অভিযানের পরিকল্পনা ও তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল জাহাজটির সমুদ্রযাত্রার রুটিন অনুসরণ করে।

১৯ জানুয়ারি সোমবার ১৯৮১ সাল। সমুদ্রযাত্রার জন্য চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে প্রস্তুত জাহাজ হিজবুল বাহারে অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রী ও বিজ্ঞানীরা আরোহণ করেন। মেধাবী ছাত্রছাত্রী ছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষা বোর্ডগুলোর চেয়ারম্যান, জাতীয় কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত বিভিন্ন বিষয়ের গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, জনপ্রিয় শিল্পী, রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাকর্মীসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী ছিলেন। সকাল ৯টায় হিজবুল বাহারের যাত্রা হয়। জাহাজে আরোহণ থেকে শুরু করে ২১ জানুয়ারি ১৯৮১ সাল বুধবার সকালে জাহাজ থেকে অবতরণ পর্যন্ত সময়ের কর্মসূচি অংশগ্রহণকারী সবাইকে আগেই সরবরাহ করা হয়েছিল। জাহাজ কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা ডেকে থাকার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে সহযোগিতা করে। অন্যদের জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনে পৌঁছে দিতেও সাহায্য করে।

পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ১০টায় শুরু হয় জাহাজের ছাদে সমুদ্রযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রপতি জিয়া সমুদ্র অভিযানে অংশগ্রহণকারী সবার কাছে এ অভিযান বা শিক্ষাসফরের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। বক্তব্যের শুরুতে তিনি ছাত্রছাত্রীদের চমকে দিয়ে প্রথমেই তাদের ডানে দেখতে বলেন এবং পরে বাঁয়ে দেখতে বলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া একজন সেনা অফিসারের মতো ছাত্রছাত্রীদের কমান্ড করেন। ছাত্রছাত্রীদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো ডানে-বাঁয়ে তাকানোর দৃশ্যটি মনোমুগ্ধকর, অন্তরঙ্গ ও আনন্দময় পরিবেশের সৃষ্টি করে। প্রায় সব ছাত্রছাত্রী হয়তো রাষ্ট্রপতি জিয়াকে এত কাছে থেকে প্রথম দেখছে। পরিবেশ হালকা করে তিনি ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে প্রশ্ন রাখলেন, তোমরা ডানে-বাঁয়ে কী দেখলে? এ ধরনের সহজ ও রহস্যময় প্রশ্ন শুনে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা একটু বিস্মিত হলো, থমকে গেল এবং খানিকটা সময় নীরবতার মধ্যে কাটল। দুই দিকেই তো সমুদ্রের পানি ছাড়া আর কিছুই তারা দেখেনি। এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরে প্রায় এক ঘণ্টার ওপরে যাত্রা হয়েছে, তাই পানির ওপরেই তো থাকার কথা। এটা কি কোনো প্রশ্ন হতে পারে? এটা ভেবে কিছুক্ষণ কেউ কোনো উত্তর দেয়নি। জিয়া ছাত্রছাত্রীদের সাহস দিয়ে জানতে চাইলেন, তোমরা যা দেখেছ তা-ই বল। এরই মধ্যে কয়েকজন হাত তুলল। তিনি একজনকে সুযোগ দিলে সে উত্তর দিল- দুই দিকেই সমুদ্রের পানি দেখতে পেয়েছি। রাষ্ট্রপতি জিয়া হেসে ছাত্রটির সঙ্গে সায় দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমি এটাই জানতে চেয়েছি। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চাপা গুঞ্জন, এটা কি কোনো প্রশ্ন হলো? পরমুহূর্তে জিয়া গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, যা তোমরা দেখছ তা শুধু সাগরের পানি নয়, এটা তোমাদের বাংলাদেশ। এ অপরিচিত বাংলাদেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য, বাংলাদেশের এ অংশের গঠন, অবস্থান, সম্পদ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত করা, বাংলাদেশের এত বিশাল পানির অংশ সম্পর্কে ভবিষ্যতে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তোমাদের বঙ্গোপসাগরে নিয়ে এসেছি। মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে রাষ্ট্রপতি জিয়া এক সম্মোহনী কৌশলে নিবিড় সম্পর্ক ও ভাববিনিময়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিলেন; যার ফলে অংশগ্রহণকারী মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে জিয়ার সান্নিধ্য তাদের জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকল। উদ্বোধনী ভাষণে রাষ্ট্রপতি জিয়া সংক্ষেপে বঙ্গোপসাগরের পরিধি, গঠন ইতিহাস, পানির ওপর ও পানির অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্তরে মৎস্যসম্পদ এবং তলদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে বক্তব্য দেন।

পূর্বনির্ধারিত সেমিনার কর্মসূচি মোতাবেক সমুদ্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত ও মতামত উপস্থাপন করেন। চায়ের বিরতি দিয়ে দুপুরে খাওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে সমুদ্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক আলোচনা উপস্থাপন করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বসে সর্বক্ষণ সেমিনারে উপস্থাপিত সব বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শোনেন। বিশেষজ্ঞদের জন্য নির্ধারিত সেমিনারে সমাপ্তি বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি জিয়া অকপটে স্বীকার করেন যে, বঙ্গোপসাগর সম্পর্কে তিনি সামান্যই জানতেন। তিনি এ সেমিনার থেকে আরও অনেক জেনেছেন এবং বঙ্গোপসাগর সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ও ধারণা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীরা বঙ্গোপসাগর সম্পর্কে অনেক জ্ঞান আহরণ করেছে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বিকালে ছাত্রছাত্রীদের জন্য সেমিনারে তার প্রতিফলন দেখতে চান।

দুপুরে খাওয়া ও বিশ্রামের পর বিকাল ৪টার দিকে শুরু হয় সেমিনারের দ্বিতীয় অংশ। এ অংশ নির্ধারিত ছিল ছাত্রছাত্রীদের জন্য। সকালের অংশে কী কী বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে তা অংশগ্রহণকারী ছাত্রছাত্রীদের আগেই অবহিত করা হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত দ্বিতীয় সেমিনারে যারা অংশগ্রহণে আগ্রহী আগেই সেই তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। সে মোতাবেক ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে সকালে উত্থাপিত বিষয়ের ওপর সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বিকালের চায়ের বিরতি দিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ সেমিনার চলে। রাষ্ট্রপতি জিয়া সার্বক্ষণিক দ্বিতীয় সেমিনারে ছাত্রছাত্রীদের বক্তব্য শোনেন এবং তাদের বস্তুনিষ্ঠ ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। চৌকশ বক্তাদের মধ্য থেকে চিহ্নিত করে তাদের রাষ্ট্রপতি জিয়া পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে সম্মানিত করেন। এমনকি এ সমুদ্র অভিযানের পর তার শাহাদাতবরণের আগে নেপালে একটি মাত্র রাষ্ট্রীয় সফরে ওই জাহাজ সেমিনারে চ্যাম্পিয়ন বিবেচিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রাশেদা বেগমকে (হীরা) (পরবর্তীতে জাতীয় সংসদ সদস্য) সফরসঙ্গী করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া মেধাকে কী পরিমাণ মূল্যায়ন করতেন তা উল্লিখিত সমুদ্র অভিযান ও তৎপরবর্তী রাষ্ট্রীয় সফরে সুযোগ দেওয়ার মধ্যে তা প্রমাণিত।

সন্ধ্যার পর মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী ও ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে আগ্রহী ছাত্রছাত্রীর তালিকা আগে থেকেই সংগৃহীত ছিল। অংশগ্রহণে ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীরাও যার যার বিষয় পরিবেশনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে এসেছিল। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয়। দ্বিতীয় পর্বে সমুদ্রযাত্রার সফরসঙ্গী জনপ্রিয় জাতীয় শিল্পীরা পারফরম্যান্স করেন। উভয় পরিবেশনার পুরো সময় রাষ্ট্রপতি জিয়া সফরসঙ্গীদের নিয়ে উপভোগ করেন। জাহাজের ওপরে ডেকে (ছাদে) চারপাশে সমুদ্রের পানি পরিবেষ্টিত একটি অপরূপ ও ব্যতিক্রমধর্মী পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ অনুষ্ঠান রাষ্ট্রপতি জিয়াসহ অংশগ্রহণকারী বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য সারা জীবনের তুলনাহীন অভিজ্ঞতা। খোলা আকাশের নিচে এবং অডিটোরিয়ামে এ ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ হয়তো অনেকের আছে কিন্তু খোলা আকাশের নিচে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রের পানির ওপরে বসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়তো ছাত্রছাত্রীসহ অংশগ্রহণকারীদের আর কখনো হয়নি। রাতযাপনের পর ২১ জানুয়ারি ১৯৮১ সাল বুধবার সকাল ৮টায় হিজবুল বাহার চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে নোঙর করে এবং সমুদ্র অভিযানের সমাপ্তি ঘটে।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কী পরিমাণ দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক হলে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বঙ্গোপসাগরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, সম্পদ ও সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে ‘সামুদ্রিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’ গঠন করেছিলেন। ওই কমিটির সমুদ্র অনুসন্ধানের দ্বিতীয় অভিযান পরিদর্শনের জন্য বিজ্ঞানী ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বঙ্গোপসাগর সফর করে। বর্তমান বিশ্বে যে নীল অর্থনীতি গুরুত্বের সঙ্গে সব দেশ বাস্তবায়নের জন্য বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করছে তার গুরুত্ব জিয়াউর রহমান ৪২ বছর আগে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। হিজবুল বাহারের ছাদে উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক বাণিজ্য, মৎস্য আহরণ, শৈবাল ব্যবহার, সমুদ্র জাহাজ চলাচল, সমুদ্র তলদেশে গ্যাস ও তেল মজুদের সম্ভাবনা, দেশের নিরাপত্তা, ইকোলজিসহ সমুদ্রবিজ্ঞানের বিভিন্ন সেক্টর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা তাঁদের গবেষণালব্ধ তথ্য বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশে নীল অর্থনীতির উন্নয়নে যে ২৬টি সামুদ্রিক কর্মপন্থা চিহ্নিত করা হয়েছে তার বেশির ভাগ বিষয় সেদিনের সেমিনারে উত্থাপিত হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উদ্যোগ ও অংশগ্রহণে আয়োজিত হিজবুল বাহারে বঙ্গোপসাগর সফর বা অভিযানের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীসহ সব অংশগ্রহণকারী বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ে অপরিসীম জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছে। সর্বোপরি বঙ্গোপসাগর যে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং এখানে যে সম্পদ ও সম্ভাবনা রয়েছে তা অংশগ্রহণকারী বিশেষ করে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের এক নতুন উপলব্ধি সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার হাজারো নতুন এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগের মধ্যে এটি একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তা, দেশপ্রেম ও উদ্ভাবনী বহু উদ্যোগের জন্যই রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমান জনগণের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মাত্র সাড়ে চার বছরে তিনি বাংলাদেশের জনগণকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম, সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সব আয়োজনের সূচনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া ঈর্ষণীয় বহুগুণের অধিকারী ছিলেন। এতসব গুণের কারণেই তিনি একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিক এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রাণের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন।

 

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সদস্য, জাতীয় স্থায়ী কমিটি-বিএনপি, সাবেক মন্ত্রী এবং অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান

ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর