শুক্রবার, ৯ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কূটনৈতিক চাল

মেজর আখতার (অব.)

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কূটনৈতিক চাল

“Today, I am announcing a new visa policy under Section 212(a)(3)(C) (Ò3CÓ) of the Immigration and Nationality Act to support Bangladesh’s goal of holding free, fair, and peaceful national election”.

ওপরে উল্লিখিত বক্তব্যটি গত ২৪ মে ২০২৩ যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেন তাঁর টুইটারে দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্যটি রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচিত হচ্ছে। অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ও ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২১২ ধারার (এ্য) উপ ধারার (৩) উপউপ ধারার (সি) উপউপউপ ধারার আওতায় নতুন ভিসা পলিসি ঘোষণা করেছেন বলে দাবি করেন। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার আগে আমরা দেখে নিতে চাই উপউপউপ (সি) ধারাতে কী আছে।

(C) Foreign policy. (i) In general.-An alien whose entry or proposed activities in the United States the Secretary of State has reasonable ground to believe would have potentially serious adverse foreign policy consequences for the United States is inadmissible.

(ii) Exception for officials.-An alien who is an official of a foreign government or a purported government, or who is a candidate for election to a foreign government office during the period immediately preceding the election for that office, shall not be excludable or subject to restrictions or conditions on entry into the United States under clause (i) solely because of the alien’s past, current, or expected beliefs, statements, or associations, if such beliefs, statements or associations would be lawful within the United States.

(iii) Exception for other aliens.-An alien, not described in clause (ii), shall not be excludable or subject to restrictions, or conditions on entry into the United States under clause (i) because of the alien’s past, current, or expected beliefs, statements, or associations, if such beliefs, statements, or associations would be lawful within the United States, unless the Secretary of State personally determines that the alien’s admission would compromise a compelling United States foreign policy interest.

(iv) Notification of determinations.-If a determination is made under clause (iii) with respect to an alien, the Secretary of State must notify on a timely basis the chairmen of the Committees on the Judiciary and Foreign Affairs of the House of Representatives and of the Committees on the Judiciary and Foreign Relations of the Senate of the identity of the alien and the reasons for the determination.

আমি শুধু সংশ্লিষ্ট (সি) উপউপউপ ধারাটি ইংরেজিতে লেখা মূল অংশটুকু তুলে ধরলাম। যে কেউ বাংলায় অনুবাদ করে নিলে কোনো আপত্তি থাকবে না। অনেকে বিষয়টি নিয়ে মনের মতো করে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। বক্তব্য যে কেউ যে কোনো বিষয়ে দিতেই পারেন। এখানে বিষয়টির সূত্রপাত হয়েছে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো সেক্রেটারি অব স্টেটের বেফাঁস বক্তব্য নিয়ে। বক্তব্যটি বেফাঁস হলো এ জন্য যে, ব্লিঙ্কেন ঘটা করে বলছেন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ও ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ২১২ ধারার (এ্য) উপ ধারার (৩) উপউপ ধারার (সি) উপউপউপ ধারার আওতায় নতুন ভিসা পলিসি ঘোষণা করেছেন। অথচ মূল আইনে তাঁকে এ ধরনের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আইনের উপউপউপ (সি) ধারার প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- যদি সেক্রেটারি অব স্টেট যুক্তিসম্মত কোনো কারণে মনে করেন কোনো বিদেশি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ তাহলে যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রবেশাধিকার থাকবে না। এ ছাড়াও এ আইনের আরও তিনটি অনুচ্ছেদ আছে, যেখানে কোথাও বলা হয়নি সেক্রেটারি অব স্টেট ভিসানীতি প্রণয়ন করবেন যার আলোকে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের নাগরিকদের সেই নিয়ম মোতাবেক ভিসা প্রদান করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা ও নাগরিকত্ব নিয়ন্ত্রণ করে তাদের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অর্থাৎ আমাদের মতো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খবরদারি সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ও ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট একটি বিশাল বড় আইন। এ আইনে মোট পাঁচটি অংশ বা টাইটেল এবং ৪০৭টি ধারা আছে। আইনটির মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা হলো ৪০৪টি। এ বিশাল আইনে সবার ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য খুবই সুস্পষ্টভাবে বিন্যাস করে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো আইনের ১০৪ এর (ক) উপ ধারায় বলা হয়েছে- ভিসা দেওয়া বা না দেওয়ার ব্যাপারে কনস্যুলার অফিসারের ক্ষমতার ওপরে সেক্রেটারি অব স্টেট কোনো খবরদারি করতে পারবে না। নিচে আইনের ১০৪ ধারা এবং (ক) উপ ধারা হুবহু তুলে ধরলাম :

ACT 104 - POWERS AND DUTIES OF THE SECRETARY OF STATE (a) The Secretary of State shall be charged with the administration and the enforcement of the provisions of this Act and all other immigration and nationality laws relating to (1) the powers, duties and functions of diplomatic and consular officers of the United States, except those powers, duties and functions conferred upon the consular officers relating to the granting or refusal of visas;

যে আইনটি উল্লেখ করে ব্লিঙ্কেন রাজনীতির ওপর হুমকি-ধমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন তা যে শুধু আস্ফালন তা বুঝতে অনেকের বাকি নেই। ভিসার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে পররাষ্ট্রনীতির কোনো প্রভাব নেই। তবে যদি কোনো ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় তাহলে আইনের উপউপউপ (সি) ধারার চতুর্থ অনুচ্ছেদ যা পূর্বে দেওয়া হয়েছে সেই মোতাবেক সেক্রেটারি অব স্টেটকে নির্দিষ্টকরণ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জানাতে হবে। তবে ওপরে উল্লিখিত দুই ও তিন অনুচ্ছেদে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে যে কেউ তার নিজ দেশে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা বিরোধিতার কারণে ওই ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া যাবে না যদি না যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়। কাজেই এটি দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ঢাকার যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বাংলাদেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা না অংশগ্রহণ, বাধা দেওয়া বা জোর করে নির্বাচিত হওয়া বা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া বা না হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভিসা আইনের আওতায় কাউকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে বাধা দিতে পারে না।

রাজনৈতিক নেতারা তাদের অনুগত নেতা-কর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীদের আবেগাপ্লূত রাখার জন্য অনেক মুখরোচক ও উত্তেজক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে থাকেন। কিছুদিন আগে যেমন আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করে আনতে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সরকারকে অনুরোধ করে এসেছিলেন বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন যা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। পরে এটি বাত কা বাত হিসেবেই এক দিন হারিয়ে যায়। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত রাশিয়ার বক্তব্যকে ধর্তব্যে আনলে এত দিনে ইউক্রেন রাশিয়ার পেটে হজম হয়ে যেত। বড় বড় শক্তিধররা এরকম হুমকি-ধমকি দিয়েই থাকে। কারণ এতে তাদের অনুসারীরা অনেক উজ্জীবিত হয়।

বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণ ও পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের দেশ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ পোশাক আমদানি করে। এতে অবশ্যই আমাদের অনেক ফায়দা আছে। তবে এটিও চরম সত্য যে, আমাদের চেয়ে কম ফায়দা যুক্তরাষ্ট্রের নেই। আমাদের চেয়ে কম মূল্যে অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানি করতে পারলে তারা চলে যেতে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করবে না। এখানে আমাদের উভয়েরই উইন উইন অবস্থা রয়েছে। কাজেই ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক। এর সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ঐতিহাসিকভাবে নির্মম সত্য যে, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিপরীত বিন্দুতে ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে খাদ্য সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলেও ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কুশীলব হিসেবে তারা কাজ করে। পরবর্তীতে এরশাদের সামরিক সরকারকে প্রতিষ্ঠা পেতে তারা গোপন অবদান রাখে। ইরাক ও আফগানিস্তান ইস্যুতে তাদের পক্ষে থাকা এবং জামায়াত ও পাকিস্তানের সঙ্গে আঁতাত করার জন্য বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ইরাকের পতন ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় জামায়াত তথা ইসলামিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য বিএনপি রাজি না হওয়ায় ১/১১ সৃষ্টি করে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। তারপর গত ১৫ বছরে জামায়াত ও তথাকথিত মৌলবাদী ইসলামিক শক্তিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। আর যেন সরকার তার বিরোধীদের দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করতে না পারে সেই জন্য অতি সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞার অস্ত্র প্রয়োগ করেছে। এখন চীনের কাছ থেকে সরে আসার জন্য সরকারের ওপর নতুন চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজকে উসকে দিচ্ছে। অথচ চরম বাস্তবতা হলো যদি কোনো পরিবর্তন সরকারে আসেও, যদিও আসার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই, তাহলেও পরিবর্তিত সরকারের পক্ষে চীনের বিপক্ষে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। বর্তমান বিশ্বের শক্তির ভারসাম্যে চীন, ভারত, রাশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক সবাই একই বলয়ে অবস্থান করে। এখন চীনের বিপরীতে যাওয়া মানে পঞ্চশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়া, যা কোনো সচেতন রাজনৈতিক দল যাবে না বা জাতীয় স্বার্থে যেতে পারে না। এ শক্তির ভারসাম্য যুক্তরাষ্ট্রও বুঝে। তাই তারা বিভিন্ন চাপ প্রয়োগ করে বাংলাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রিত বলয়ে রাখার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এ চেষ্টারই একটি প্রচেষ্টা ভিসা নিয়ে ছলচাতুরীর আশ্রয়। ছলচাতুরী রাজনৈতিক ও কূটকৌশলেরই অংশ। এটি খারাপ কোনো কাজ নয়।

এখন দেশবাসীর সবার একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চরম আকাক্সক্ষা। এর পক্ষে যে বা যারাই থাকবে জনগণ তাদেরই অতি আপন বলে কাছে টেনে নেবে। জনগণের এ কাক্সিক্ষত দাবি পূরণে সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। সরকারের স্পষ্ট অবস্থান হলো- তাদের অধীনেই সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব, যা অতীতে তারা ছাড়া অন্য কেউ দিতে পারেনি। আবার মূল বিরোধী দল বিএনপি মনে করে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়নি এবং আগামীতেও হবে না। ফলে তারা বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। এ দুই চরম বিপরীতমুখী অবস্থানকে নমনীয় করার জন্য ব্লিঙ্কেন ভিসার তাবিজ বাজারে ছেড়েছেন। ভিসার ভয় দেখিয়ে যদি উভয় পক্ষকে নমনীয় করে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করানো যায় তাহলে এর পুরো কৃতিত্ব ব্লিঙ্কেন তথা যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে জনগণের সামনে নতুন ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারবে। প্রচেষ্টাটি অবশ্যই মহৎ। এখন দেখতে হবে বড় দুটি দল এ মহৎ প্রচেষ্টার ডাকে কতটুকু সাড়া দেয়। তবে ব্লিঙ্কেন তথা যুক্তরাষ্ট্র যে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় তা ব্লিঙ্কেনের টুইটার বার্তায় পরিষ্কার হয়ে গেছে, যার জন্য আমরা সবাই তাঁকে আগাম সাধুবাদ জানাতেই পারি। কারণ আমরা সবাই আগামীতে একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চাই- তা যার অধীনেই হোক না কেন।  

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

সর্বশেষ খবর