বিচারাধীন মামলার কারণে দীর্ঘ কারাবাসের অবসান ঘটিয়ে একে একে বহু মামলার আসামিরা খালাস পাচ্ছেন। বিগত ১৬ বছরে দুর্নীতির ষোলকলা পূর্ণ করার বিবরণসংক্রান্ত ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র প্রকাশ পেয়েছে। অন্যদিকে দেশ, উপমহাদেশ ও বিশ্ব পরিমণ্ডল নয়, ছোট্ট একটি বাজারে গিয়েও ক্রমাগত হতাশ হচ্ছে সাধারণ জনগণ। এভাবেই খালাস, প্রকাশ আর হতাশসংক্রান্ত যাবতীয় খবর নিয়ে সপ্তাহজুড়ে উত্তপ্ত ছিল রাজনীতি ও অর্থনীতির বাতাস।
বাংলাদেশের ৫৩ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে ঘটে যাওয়া কলঙ্কময় ৫৩টি রাজনৈতিক ঘটনার যদি তালিকা করা হয়, তবে সেই তালিকার প্রথম তিনটির একটি হতে পারে ২০০৪ সালে ২১ আগস্টে ঘটে যাওয়া গ্রেনেড হামলা। এদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগ আয়োজন করেছিল বোমা হামলা ও সন্ত্রাসবিরোধী এক জনসভা। সেই জনসভার শেষ দিকে খোলা ট্রাকে বানানো অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা। সন্ধ্যার আগে আগে বক্তৃতা শেষ করার পরপরই সেই খোলা ট্রাক তথা শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে পাশের একটি বহুতল ভবন থেকে ১৩টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। তাৎক্ষণিক এই গ্রেনেড হামলা থেকে শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু বুলেট প্রুফ গাড়িতে উঠে নিজ বাসভবনে যাওয়ার পথে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে মারণাস্ত্র থেকে অসংখ্য গুলি করা হয়। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে গ্রেনেড হামলায় আহতদের চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় আরও অভিযোগ উঠেছিল আলামত নষ্ট এবং বিভিন্ন মিডিয়া হাউস থেকে প্রামাণ্য সব নথিপত্র বিশেষত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ জোর করে একটি সংস্থা কর্তৃক উঠিয়ে নেওয়ার। আর প্রশ্ন উঠেছিল এই হামলার সময় একান্তই সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যদের জন্য প্রস্তুত ও সরবরাহ করা আর্জেস গ্রেনেড হামলাকারীদের হাতে কীভাবে পৌঁছল।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গ্রেনেডকে বলা হয় ‘ডাবল এজড ওয়েপন’ বা দ্বিমুখী অস্ত্র। নিরাপত্তা পিন খোলার পর গ্রেনেডের গায়ে সংযুক্ত একটি ধাতব পাতসহ (লিভার) গ্রেনেডটি যতক্ষণ তালুবন্দি রাখা যায়, ততক্ষণই তা নিরাপদ। এরপর শত্রুর দিকে ছুড়ে ফেলার অর্থাৎ পিনযুক্ত লিভারটি ছেড়ে দেওয়ার ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। এই ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে নিজেকে নিরাপদ স্থানে বা আড়ালে লুকাতে না পারলে শত্রুর সঙ্গে নিজেকেই হতাহতের শিকার হতে হয়। তাই নিরাপত্তা পিন খোলার পর একটি গ্রেনেড নিজের তালুবন্দি রাখার জন্য মনের মধ্যে কঠোর শক্তি থাকতে হয়। মানসিক শক্তির অভাবে পিন খোলামাত্র হাত থেকে গ্রেনেড মাটিতে ফেলে নিজের ও সহযোদ্ধা বা সহপ্রশিক্ষণ গ্রহণকারী এমনকি প্রশিক্ষকের বিপদ বা নির্মম মৃত্যু ডেকে আনার বহু ঘটনা ঘটেছে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের ইতিহাসে। এ জন্য সৈনিকদের প্রথমে খালি হাতে কাল্পনিক গ্রেনেড ছোড়ার কসরত করানো হয়। এরপর গ্রেনেড আকৃতির কাঠ বা পাথর ছোড়া হয়। তারপরে কেবল শব্দ বা ধোঁয়া হয় এমন স্পিন্টারবিহীন গ্রেনেড নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সবশেষে আসে প্রকৃত গ্রেনেড নিক্ষেপ প্রশিক্ষণের পালা।
২০০৪ সালের একুশে আগস্ট হামলাকালে গ্রেনেড নিক্ষেপকারীদের কেউ হতাহত হয়নি। এত মৃত্যু, এত ভয়াবহতা, এমন অমানবিক আর্তনাদের পরও গ্রেনেড নিক্ষেপকারীরা শান্ত মাথায় ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এতে হামলাকারীদের দক্ষ প্রশিক্ষণ, দৃঢ় মনোবল আর সুচিন্তিত পরিকল্পনার প্রমাণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে করা এই হামলাকারী? কে তাদের এভাবে প্রশিক্ষিত করেছে? কোথায় হলো এমন প্রশিক্ষণ? গ্রেনেডের মতো মারণাস্ত্র তারা কোথায় পেল? না, এমন কোনো প্রশ্নের উত্তর সেদিন মেলেনি। তবে মিলেছে দারুণ এক তত্ত্ব! যার নাম জজ মিয়াতত্ত্ব! মানসিক ভারসাম্যহীন জজ মিয়া নামের এক ভবঘুরে সুন্দর একখানা স্বীকারোক্তি দিল যে, সে নিজে এই গ্রেনেড হামলা করেছে। যে ব্যক্তি ঠিকমতো একটি ঢিল ছুড়ে মারতে পারে না, সেই একই ব্যক্তি ভয়ংকর একটি গ্রেনেড শান্ত মাথায় নিরাপত্তা পিন খুলে ছুড়ে মেরেছে বলে আদালত বিশ্বাস করে। ফলে জজ মিয়াকে জজ সাহেব (বিচারক) জেলে পাঠান।
এরপর ২০০৮ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। আর তখন থেকেই ঘটতে থাকে উল্টো ঘটনা। যাকে তাকে জঙ্গি বানিয়ে জেল, জুলুম ও গুমের ঘটনা ঘটতে থাকে যখন তখন। নজিরবিহীনভাবে গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি মুফতি হান্নানকে বিভিন্ন অজুহাতে ১৬৭ দিন একনাগাড়ে রিমান্ডে রেখে সম্পূরক স্বীকারোক্তির নামে দ্বিতীয়বার সাক্ষ্য নেওয়া হয় এবং মহামান্য আদালত তার সাক্ষ্যে সন্তুষ্ট হয়ে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন।
এতে আসামি করা হয় বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ৪৯ জনকে। একসময় বিচারের রায় দেওয়া হয় এবং রায়ে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেওয়া হয়। জেলে যাওয়ার পর মুফতি হান্নান তার দেওয়া দ্বিতীয় বক্তব্য প্রত্যাহারের আবেদন করেন এবং জোর করে তার স্বীকারোক্তি আদায়ের অভিযোগ আনেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? এরই মধ্যে অন্য এক মামলায় মুফতি হান্নানকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আর গ্রেনেড হামলাজনিত বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলতে থাকে বছরের পর বছর। ভাবতে অবাক লাগে, এরই মধ্যে যদি ১৯ জনের ফাঁসি হয়ে যেত, আর আজ প্রমাণিত হতো এটি ছিল সাজানো রায়, তাহলে কী হতো? বিচারকরাও মানুষ। তাঁদেরও ভুল হতে পারে। এমন যুক্তি থেকে বিশ্বের বহু দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। মৃত্যুদণ্ডই যদি সমাধান হতো, তবে আদালতকে আর সংশোধনাগার বলার সুযোগ থাকে না বলে মনে করেন মৃত্যুদণ্ডপ্রথার বিপক্ষ অবলম্বনকারীরা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর পর এই মামলা নতুন মোড় নেয়। ফলে এই সপ্তাহে আদালতের রায়ে খালাস পান তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আগে সাজা পাওয়া সব আসামি।
তবে ফৌজদারি মামলা কখনো তামাদি হয় না। তাই প্রকৃত সত্য উদঘাটন এখন সময়ের দাবি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয়েছে এবং এতে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে, এটা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার হতেই হবে। মনে রাখতে হবে, এই প্রজন্মের অনেকেই বিদ্যা বালান আর রানী মুখার্জির অভিনীত ও বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত থ্রিলারধর্মী ভারতীয় সিনেমা ‘নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা’ দেখেছে। বাস্তবে বেঁচে থাকলে আসছে ৬ জানুয়ারি মডেল জেসিকার ৬০ বছর হতো। ১৯৯৯ সালের ৩০ এপ্রিল ৩৪ বছর বয়সে এক অনুষ্ঠানে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ৪৬ বছর বয়সি মনু শর্মা। তবে মনু শর্মার বাবা বিনোদ শর্মা ছিলেন ধনী, প্রভাবশালী ও হরিয়ানা রাজ্যের রাজ্যসভার সংসদ সদস্য (এমপি)। তাঁর প্রভাব ও টাকার জোরে তেমন সাক্ষী পাওয়া যায়নি। তদুপরি যারা সাক্ষী দিয়েছিল, তারাও তাদের সাক্ষ্য পরিবর্তন বা প্রত্যাহার করে। জেসিকার দেহ ভেদ করা গুলির কার্তুজ বা খোলস এমনকি বুলেটও বদলে ফেলে দুর্নীতিগ্রস্ত পুলিশ। মিডিয়ার একাংশ বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে দেয়। এ সময় সচেতন মহলে একটি কথা বারবার উচ্চারিত হতে থাকে ‘নো ওয়ান কিল্ড জেসিকা’ এবং এই নামেই পরবর্তী সময়ে সিনেমাটি নির্মিত হয়েছিল। পরে অবশ্য বিচারের রায় হয় এবং শাস্তি হিসেবে ২০ বছরের কারাদণ্ড পান মনু শর্মা। সাড়ে ১৩ বছর কারাদণ্ড ভোগের পর কারাগারে ভালো ব্যবহার করার সুবাদে ২০২০ সালের জুন মাসে মনু মুক্তি পান। আমরা চাই না ‘কেউ গ্রেনেড নিক্ষেপ করেনি’ কিংবা ‘সাগর-রুনিকে কেউ হত্যা করেনি’ নামের কোনো সিনেমা নির্মিত হোক নতুন বাংলাদেশে। ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো রিজার্ভ চুরি হয়নি’ শিরোনামে কোনো নাটকও দেখতে চাই না আমরা। ‘ব্যাংকের টাকা- চল্লিশ চোর’ নামের কোনো যাত্রাপালাও দেখতে চায় না সাধারণ মানুষ।
যেদিন গ্রেনেড হামলার তথাকথিত সব আসামি খালাস পান, সেদিনই প্রকাশ পায় ৪০০ পাতার শ্বেতপত্র। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক সমাজ ও গবেষকরা ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে অনেকের জন্য অপ্রিয় এই শ্বেতপত্র তুলে দেন ড. মো. ইউনূসের হাতে। বিগত ১৬ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলে যে পরিমাণ অর্থ লোপাটের তথ্য এই শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে, তার আংশিকও যদি সত্য ও প্রমাণিত হয়, তবে বুঝতে হবে এ দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীদের বিপথগামী অংশ অর্থ আর বিত্তবৈভবের নেশায় রীতিমতো উন্মাদ হয়ে গেছে। আর সামাজিক নিরাপত্তা ও একজন পালিয়ে বেড়ানো ভবঘুরে বা উন্মাদের নিজের নিরাপত্তার জন্য তাকে জোরপূর্বক মানসিক হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা প্রদান বা জেলে রেখে সংশোধন করাই যুক্তিযুক্ত ও আইনসিদ্ধ। সরকার সেই যৌক্তিক ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এটাই এখন প্রত্যাশা। আসামি খালাস আর শ্বেতপত্র প্রকাশ দেখে হয়তো অনেকেই হতাশ। তবে সবচেয়ে বেশি হতাশ নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। অতীতে এমন শীতের দিনে ক্রেতা বা উপযুক্ত দাম না পেয়ে অনেক কৃষক ও ফড়িয়া হাটবাজার বা রাস্তায় সবজি ফেলে বাড়ি ফিরতেন। আজ শীতের সবজির বাজারেও নেই স্বস্তির বাতাস। তাই দেখে সাধারণ মানুষ হতাশ। তবে কি খালাস, প্রকাশ আর হতাশ- এই নিয়েই আজকের বাংলাদেশ?
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email: [email protected]