ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। গোসল করে গামছা দিয়ে গা মুছতে গেলে দেখা যায় গামছা আগুনের মতো গরম হয়ে আছে। লুঙ্গিতে হাত দিয়ে হাত সরিয়ে ফেলতে হয়। গরমে তেতে আছে পাতলা গেঞ্জিটাও। বিছানায় পিঠ আর বালিশে মাথা লাগানোর জো নেই। সবই গরম। এ হলো প্রকৃতির রুদ্র রূপ। তেজে যেন ফেটে পড়তে চাইছে দূর আকাশের সূর্যটা। মানুষ আর প্রাণীকুলের কষ্ট হলেও তীব্র এ তাপ আসলে আল্লাহর রহমতের লীলারই অংশ। ফসল ও ফলের জন্য এ সময় গরম জরুরি। শুধু তা-ই নয়, মানুষের সুস্থতার জন্যও প্রয়োজন গরম। পরিবেশবিদরা বলছেন, ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এমন গরম আবহমানকাল ধরেই দেখা যায়। কিন্তু অস্বাভাবিকতা অন্য খানে। সূর্যের তাপের সঙ্গে আমরা নিজেরা যে অতিরিক্ত তাপ যোগ করি, সেটাই আসলে আমাদের প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে। এতে বিষিয়ে উঠছে আমাদের জীবন। শুধু কি তাই? আমাদের গোনাহের শাস্তি পাচ্ছে অন্যান্য জীবজন্তুও।
আল্লাহতায়ালা এ পৃথিবী টিকিয়ে রেখেছেন নীল আর সবুজ দিয়ে। নীল মানে হলো জল। আর সবুজ মানে হলো গাছপালা। পৃথিবীর তিন ভাগ জল। বাকি এক ভাগ স্থল। স্থলের বেশির ভাগ জুড়েই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন গাছপালা। এ পৃথিবী শুধু মানুষের বসবসারে জন্যই গড়া হয়নি। এখানে আছে প্রাণীকুল। ছোট্ট পিঁপড়া থেকে শুরু করে মস্ত তিমিও এ পৃথিবীর আপনজন। কোথাও যদি পিঁপড়ারা বিপন্ন হয়, তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে সেটার প্রভাব পড়বে কৃষি-জলাশয় সর্বোপরি মানুষের জীবনধারার ওপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জাপানে পিঁপড়াদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে ভূমিকম্প সম্পর্কে পূর্বপ্রস্তুতি নেয় সেখানের মানুষজন। আবার আমাদের দেশেও পোকামাকড়ের ওড়াউড়ি, পাখির ডাকাডাকি পর্যবেক্ষণ করে গ্রামের কৃষকরা রোদবৃষ্টির আগাম সংবাদ জানতে পারে। এমনকি সামনের মৌসুমে ফসলের বাড়তি যত্ন নিতে হবে কি না, তাও বলে দেয় মাটির পোকা, বনের ঝিঁঝি। তাই নিজের স্বার্থেই মানুষকে প্রকৃতির এসব উপাদানের টিকে থাকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা নিজের সুখের জন্য এমন সব ব্যবস্থার আবিষ্কার করেছি, যাতে আমাদের ও প্রাণীকুলের জীবন বিষিয়ে উঠছে। আল্লাহতায়ালা প্রাণীকুলের বসবাস উপযোগিতা বজায় রাখার দায়িত্ব মানুষের কাঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা অতি যত্নের সঙ্গে সে দায়িত্ব অবহেলা করে চলছি।
আমাদের ওপর ফরজ ছিল প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখা। নদী পরিষ্কার রাখা। বৃক্ষ ও বন ধ্বংস না করা। কিন্তু আজ আমাদের দেশের একটি নদীও দুষণমুক্ত নেই। আমরা হাতে ধরে সব খাল-জলাশয় নষ্ট করে ফেলেছি। আমরা পুকুর ভরাট করে সেখানে ঘর তুলেছি। অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল মনে করে বন ও গাছ উজাড় করেছি। ওই বনে যে প্রাণী থাকত, ওই গাছে যে পাখি বসত, ওই নদীতে যে মাছ বসবাস করত, ওই পুকুরপাড়ে যে সাপ ঘর বেঁধেছিল, তাদের সবার অভিশাপ আমাদের ওপর ঝরছে। স্বয়ং আল্লাহ আমাদের ওপর রাগ হয়েছেন এভাবে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করার কারণে। ফলে আজ হিটস্ট্রোক, ডেঙ্গু, ডায়াবেটিক, করোনা, ক্যানসারসহ জানা-অজানা শারীরিক ও মানসিক নানাবিধ ব্যাধি আমাদের ওপর চেপে বসেছে। এগুলো আসলে আল্লাহর গজব ছাড়া কিছুই না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ যখনই জান্নাতের আলোচনা করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে নদীর কথাও বলেছেন। নদী ছাড়া জান্নাতের উল্লেখ আল্লাহ করেননি। পৃথিবীর বুকে যত সভ্যতা গড়ে উঠেছে, সব ছিল নদীকেন্দ্রিক। আল্লাহর অশেষ দয়ায় নদীমাতৃক দেশে আমাদের জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর সব প্রেম, মমতা, সভ্যতা আল্লাহ আমাদের দান করেছিলেন নদীর মাধ্যমে। আমরা সে নদীগুলো হত্যা করে হয়েছি দুনিয়ার সবচেয়ে অসভ্য-লোভী-অসৎ জাতি। যে কারণে আজ গরমের গজব আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। পরিবেশবিজ্ঞান বলে, যখন কোনো জনপদের খালবিল-জলাশয় ধ্বংস হয়ে যায়, সে এলাকায় গরমের তীব্রতা বেড়ে যায়। বিষয়টি আরও সহজ করে বলা যায় এভাবে, সূর্যের তাপ সরাসরি পানিতে পড়লে পানি তাপ শোষণ করে নেয়। মাটির ওপর পড়লে মাটিও তাপ শোষণ করে নেয়। একইভাবে ইট-সুরকির বাড়িতে যখন সূর্যের তাপ পড়ে সেখানেও তাপ জমা হয়। পানি ও মাটি নিজ নিজ তাপ হজম করতে পারলেও ইট-সুরকি সেটা হজম করতে পারে না। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে আলেমদের এগিয়ে আসতে হবে। জুমার আলোচনায়, ওয়াজের ময়দানে নদী-খাল-বৃক্ষ-বন নিয়ে বারবার বলতে হবে।
লেখক : প্রিন্সিপাল, সেইফ এডুকেশন ইনস্টিটিউট