মহান আল্লাহতায়ালা সুরা কাহাফের ৪৬ নম্বর আয়াতে বলেন, সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা। হ্যাঁ, সন্তান আল্লাহর পক্ষ থেকে মা-বাবার জন্য নেয়ামত। পিতা-মাতার কাছে সন্তান খুব আদরের হয়। পৃথিবীতে একটি সন্তান আগমনে পুরো পরিবারে খুশির আমেজ ভরে ওঠে। দাদা-দাদি, নানা-নানি, মামা-ফুফুু সবার ভালোবাসা পরিবারের উজ্জ্বল করা বাবা-মায়ের আদরের সন্তানের দিকে। মা-বাবা তাদের সব ত্যাগ ও ভালোবাসা বিলিয়ে দেন সন্তানকে। এখন সেই সন্তানের নিথর দেহ মা-বাবার সামনে। যে মা সকালে নাশতা বানিয়ে সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। দুপুরে সন্তানের পছন্দের খাবার রান্না করতে ব্যস্ত, সেই সন্তান হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে। কেউবা আদরের কলিজার টুকরো সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। কথা বলার শক্তি হারিয়ে পাথর হয়ে গেছে। যে হাত দিয়ে সন্তানকে আদর করতেন, কোলে নিতেন, গোসল করিয়ে দিতেন, খাবার খাওয়ানোসহ ঘুমে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, আবার আদর করে বকুনি দিতেন। দৌড়ে এসে সেই সন্তান মায়ের কোলে হাজির হতো, এখন সেই সন্তানের নিথর দেহ দেখে প্রত্যেক মা পাগলপ্রায়। সন্তানের ছোট ছোট আর্জি ও মা-বাবা বলে ডাক কখনো আর শোনা যাবে না। যে সন্তানকে মা-বাবা কোথাও যেতে দিত না, সে-ও মা-বাবাকে রেখে থাকতে পারত না, এখন একাকী কবরে শুয়ে আছে। আহা কী নির্মম। কষ্টে মা-বাবার বুকটা ফেটে যায়। তাদের এ আদরের সন্তান পিতা-মাতাকেও ভুলবে না। তাদের সঙ্গে নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে, ইনশা আল্লাহ। তাদের জান্নাতের প্রজাপতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। হজরত আবু হাসসান (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-কে বললাম, ‘আমার দুটি সন্তান মারা গেছে। আপনি কি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করবেন, যাতে আমার হৃদয় সান্ত্বনা পায়? তখন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হ্যাঁ, আমি রসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘ছোট বয়সে মৃত্যুবরণকারী সন্তানরা জান্নাতের প্রজাপতির মতো। তারা যখন বাবা অথবা বাবা-মায়ের উভয়ের সঙ্গে মিলিত হবে তখন তার পরিধেয় কাপড় কিংবা হাত টেনে ধরবে, যেভাবে এখন আমি তোমার কাপড়ের আঁচল ধরেছি। এরপর সেই কাপড় বা হাত আর ছাড়বে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা তাকে ও তার মা-বাবাসহ জান্নাতে প্রবেশ না করাবেন। (মুসলিম শরিফ)।
আদরের সন্তানের মৃত্যুতে প্রতিটি পরিবারে শোকের মাতম চলে। সন্তানের নিথর দেহ মা বিদায় দিতে চায় না। সন্তানের দেহ বাবার কাঁধে। কখনো ভেবেছিল এমনটি হবে। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ এটা খুবই কষ্টদায়ক। তবে এই সন্তান মা-বাবার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেবে। হজরত কুররা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বসলে তখন অনেক সাহাবি তাঁর কাছে এসে বসতেন। এদের মধ্যে একজন সাহাবির একটি শিশু পুত্রসন্তান ছিল। তিনি তার ছেলেকে পেছন থেকে নিজের সামনে এনে বসাতেন। তার ছেলেটি মৃত্যুবরণ করলে খুব বিষণ্ন হয়ে পড়লেন। ছেলের শোকে রসুলুল্লাহ (সা.) এর মজলিসে উপস্থিত হতেন না। রসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, সেই সাহাবিকে উদ্দেশ্য করে অন্যদের বললেন, ‘তাকে দেখছি না কেন?’ সাহাবিগণ বললেন, ‘ইয়া রসুলুল্লাহ! আপনি তার যে ছোট ছেলেকে দেখেছিলেন সে মৃত্যুবরণ করেছে।’ এ কথা শুনে রসুলুল্লাহ (সা.) তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘তোমার ছেলেটির কী হয়েছে?’ উত্তরে সাহাবি বললেন, ‘ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে।’ তখন রসুলুল্লাহ (সা.) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে বললেন। তারপর বললেন, তোমার কাছে কোনটা বেশি পছন্দনীয়, তার দ্বারা তোমার পার্থিব জীবন সুখময় করা নাকি কাল কেয়ামতে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে তুমি প্রবেশ করতে চাইবে, তাকে সেখানেই পাওয়া, যেখানে সে পৌঁছে তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেবে?’ সাহাবি বললেন, ইয়া রসুলুল্লাহ, সে আমার জান্নাতের দরজায় গিয়ে আমার জন্য দরজা খুলে দেবে; এটাই আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়।’ তখন রসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তাহলে তোমার জন্য তাই হবে।’ (নাসায়ি শরিফ)। প্রিয় পাঠক, আসুন আমরা দোয়া করি। সন্তানহারা পরিবারকে সান্ত্বনা দিই। অসুস্থ অবস্থায় যারা রয়েছে তাদের সহযোগিতা করি। বান্দার মঙ্গলের জন্যই কিন্তু আল্লাহ সবকিছুই করেন। মুমিন কখনো ভেঙে পড়ে না। সর্বদা ধৈর্য ধারণ করে। ধৈর্যের পক্ষে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন ও ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহ অবশ্যই সৎ কর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত : ৯০)।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক