এ প্রজন্মের ঘরবন্দি শিশুরা কোথায় যাবে? কোথায় একটু মুক্তাঙ্গনে শুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেবে? সবুজ মাঠে দদণ্ড খেলবে? এ প্রশ্ন দিনকে দিন প্রকটভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে দেশের সব নগর-মহানগর, শহর-বন্দরে। বাদ নয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর, বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত, বন্দর নগরী চট্টগ্রামও।
বিনোদন-শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের অনুষঙ্গ। শিশুদের মনন বিকাশে বিনোদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি শিশুর চিন্তা-চেতনা, সৃষ্টিশীলতা সমৃদ্ধ করতে খেলাধুলার প্রভাবও অনন্য। তাই শিশুদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে উন্মুক্ত আঙিনা জরুরি। কিন্তু দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরে তিনটি বিনোদন কেন্দ্র এক বছর ধরে বন্ধ। একটি বছর ধরে কোমলমতি শিশুরা তিনটি বিনোদন কেন্দ্রের নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত। চার দেয়ালের বাইরে মুক্ত আঙিনায় খেলতে বা আনন্দ করতে না পারায় শিশুরা স্বভাবতই প্রযুক্তিমুখী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অতিমাত্রায় প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহার করায় আগামী প্রজন্মকে পরোক্ষভাবে বিকলাঙ্গ করা হচ্ছে না তো? চট্টগ্রাম নগরে প্রতিনিয়তই বাড়ছে ইট-কংক্রিটের বহুতল ভবন, কমছে মুক্তাঙ্গন। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কবলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে উন্মুক্ত স্থান। কমছে খেলার মাঠ। তাহলে প্রশ্ন- শিশুরা যাবে কোথায়? খেলবে কোথায়? কীভাবে শিশুর মনোবিকাশ হবে? কোথায় গিয়ে আনন্দ করবে? অথচ খেলার জায়গা না পাওয়ায় শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে দারুণ খেসারত দিতে হচ্ছে।
১৯৯১ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠের একাংশে কর্ণফুলী শিশু পার্কের জন্য ৯ একর জমি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) ইজারা দেওয়া হয়। ২০০০ সালে পার্ক নির্মাণ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেটি বন্ধ। অন্যদিকে ২০০৬ সালে ১১ একর জায়গার ওপর বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থাপনার রেপ্লিকা নিয়ে নগরের চাদগাঁওয়ে তৈরি করা হয় ‘জিয়া স্মৃতি কমপ্লেক্স’। পরে সেটা ‘স্বাধীনতা কমপ্লেক্স’ নামকরণ করা হয়। এ কমপ্লেক্সে সংসদ ভবন, শহীদ মিনার, সোনামসজিদ, কান্তজিউ মন্দির, আহসান মঞ্জিল, সুপ্রিম কোর্ট ও স্মৃতিসৌধের রেপ্লিকা আছে। পার্কের মূল আকর্ষণ ছিল প্রায় ২০০ ফুট উঁচু টাওয়ারে থাকা ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁ। ২৩ তলা উচ্চতায় অবস্থিত এই রেস্তোরাঁ থেকে একনজরে পুরো চট্টগ্রাম শহর ও কর্ণফুলী নদী দেখার সুযোগ ছিল। তা ছাড়া ১৫টির বেশি রাইড, ছোট-বড় রেস্তোরাঁ ছিল পার্কের ভিতর। এটিও বন্ধ। নগরের কাজির দেউড়ি এলাকায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জায়গায় চসিক একটি প্রাইভেট কোম্পানিকে পার্ক করতে বরাদ্দ দিয়েছিল। জিয়া স্মৃতি শিশু পার্ক নামের সেই পার্কটি ২০২৩ সালে সরকার উচ্ছেদ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে জায়গা বুঝিয়ে দেয়। ফলে তিনটি পার্কই এক বছর ধরে বন্ধ। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ মে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সার্কিট হাউস এবং তার পাশের বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণকে (প্রায় ৩.৮৯ একর) সর্বজনীন নাগরিক মুক্তাঙ্গন হিসেবে ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম।
স্বাধীনতার পর সাড়ে পাঁচটি দশক পার হলো। অথচ এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে একটি স্থায়ী শিশু পার্ক তৈরি করা হলো না। যে তিনটি ছিল, সেগুলোও এখন বন্ধ। তাহলে শিশুরা যাবে কোথায়?
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ২০০৮ সালে নগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) প্রণয়ন করে। ড্যাপের মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার জন্য পাঁচ একরের একটি পার্ক বা খেলার মাঠ রাখার কথা। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, নগরে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলে ৭০ লাখ মানুষের বসবাস। সে হিসাবে চট্টগ্রাম নগরে প্রায় ৭০০টি খেলার মাঠ ও পার্ক এবং ৩ হাজার ৫০০ একর জায়গা সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবতা? বাস্তবে চসিকের ৪১টি ওয়ার্ডে খেলার মাঠ আছে মাত্র ১৯০টি। পার্ক আছে পাঁচটি। খেলার মাঠগুলোর অধিকাংশরই মালিক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে সেগুলোতে অনেকাংশেই প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। বাস্তবতা হলো নগরে শিশুদের খেলাধুলার মাঠ-মুক্তাঙিনা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। এটা চলতে পারে না। অথচ নগরের সেবা সংস্থাগুলোর কাছে কত প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি শোনা যায়। বিশ্বমানের, শিশুবান্ধব, ক্লিন-গ্রিন ও পরিবেশবান্ধব নগর প্রতিষ্ঠার কথা অন্তত তিন দশক ধরে শোনানো হচ্ছে। বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর নয় কথার ফুলঝুরি। শিশুদের জন্য তৈরি করা হোক স্থায়ী পার্ক। গড়ে উঠুক পরিকল্পিত নগর। রক্ষা পাক মুক্তাঙ্গন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলুক আগামী প্রজন্ম।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী