বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা
ক্ষুব্ধ মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা

নাটকে অশালীন ভাষা

আলাউদ্দীন মাজিদ

নাটকে অশালীন ভাষা

‘এ ধরনের নিম্ন রুচির নাটক কারা নির্মাণ করছেন এবং এতে কারা অভিনয় করছেন সবাই পরিচিত। এক্ষেত্রে শিল্পীদের মধ্যে সচেতনতা প্রয়োজন। দেখে শুনে মনে হচ্ছে শুধুই অর্থ উপার্জনের জন্য এ ধরনের অনৈতিক পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। অর্থ ময়লার ভাগাড় থেকেও উপার্জন আবার কাজ করেও আয় করা যায়। এক্ষেত্রে বিবেক ও দায়বদ্ধতা যদি কাজ না করে তাহলে অবক্ষয় তো আসবেই। এরা যদি নিজেদের না শোধরান তাহলে এ অবক্ষয় রোধ করবে কে? এর খারাপ প্রভাব পড়ছে সমাজ ও নতুন প্রজন্মের ওপর। এখন পারিবারিক নাটকের পরিবর্তে প্রেম আর মোবাইলনির্ভর নাটক বেশি নির্মাণ হচ্ছে। আর এ ধরনের নাটককে অবলম্বন করেই কুরুচির আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। পারিবারিক গল্প হলে তাতে অশালীন কোনো বিষয় আসা সম্ভব নয়। যারা এসব নিয়ন্ত্রণ করে তাদের মধ্যেও কোনো সচেতনতা নেই। আধুনিকতার পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উন্নত প্রযুক্তি আশীর্বাদ স্বরূপ। কিন্তু এ প্রযুক্তিকে আমরা ভালো কাজে ব্যবহার করছি না কেন? ফেসবুক আর মাদকাসক্তির মতো এ অবক্ষয়ের প্রতিও এখন তরুণ প্রজন্ম ধাবিত হবে। এটি মিডিয়ার জন্য একটি অন্ধকার দিক। যা কোনো সচেতন নাগরিকের কাম্য হতে পারে না। সবাই মিলে একে প্রতিহত করা উচিত।’ চরম ক্ষোভ নিয়ে কথাগুলো বলেছেন প্রখ্যাত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হানিফ সংকেত।

সম্প্রতি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নাটকের বিকৃত ও ইউটিউবের নাটকের মধ্যে অশালীন ভাষার ব্যবহার ও অনৈতিক দৃশ্য দেখানোর প্রবণতা চলছে, এটি শুধু নাটকেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। গানের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে নাটক আর গান বিমুখ হয়ে পড়ছে দর্শক। আর তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তৈরি হচ্ছে অনৈতিকতা আর অবক্ষয়। একই কারণে ইতিপূর্বে ঢাকাই চলচ্চিত্র হারিয়েছে দর্শক।

টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রিভিউ বোর্ড থাকায় সেখানে অশ্লীল এবং কুরুচিপূর্ণ অকথ্য গালাগালে সয়লাব নাটক প্রচার সম্ভব না হলেও ভাষাকে বিকৃত করে প্রচার হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে আর ইউটিউবে প্রিভিউ বোর্ড না থাকায় সেখানকার নাটকে প্রায়শই অশ্লীল বাক্য প্রয়োগের ছড়াছড়ি চলছে, এমন অভিযোগ অসংখ্য দর্শকের। গল্পের কমন ফর্মুলা এখন দুজন মানব-মানবীর প্রেম অথবা দাম্পত্য। সেখানে না থাকছে গল্পের, চরিত্রের আর লোকেশনের বৈচিত্র্য। থাকছে না অভিনয়শিল্পীদের বৈচিত্র্যতাও। ঘুরে-ফিরে একই মুখ মানে অভিনয়শিল্পী নিয়ে নির্মিত হচ্ছে নাটক। এতে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন নাটক থেকে। নাটকগুলোতে কমন সংলাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বাবু’ ও ‘সোনা’। নাটকের অনুষঙ্গ হয়ে পড়েছে অপ্রয়োজনীয় গান। যা কেবলই নাটকের সময়কে দীর্ঘ করা ছাড়া আর কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বলার অপেক্ষা রাখে না, নাটক এখন গানকে সাপোর্ট দিচ্ছে মিউজিক ভিডিও হিসেবে। অনেক টিভি চ্যানেল নিজেদের মানুষ দিয়ে নাটক নির্মাণ থেকে শুরু করে সবই করছে বলে সেই নাটকের মানও থাকছে না।

প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের বলেন, তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অনেকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান রাখার প্রয়োজনবোধ করে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার বিকৃতিটাকে তেমন কিছু মনে হয় না তাদের কাছে। আমাদের মনে রাখা উচিত সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আমরা যে কোনো মাধ্যমে

যা-ই করি না কেন, সেখানে শুদ্ধরূপে প্রমিত বাংলার ব্যবহার থাকা উচিত। নাটক-সিনেমার সংলাপ লিখতে গেলেও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। আমি মনে করি, নাটক-সিনেমায় যারা অশালীন ভাষা ব্যবহার করছেন তারা ভুল করছেন। এটা অনৈতিক।

বিশিষ্ট টিভি অভিনেতা ড. ইনামুল হক বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমাদের নাটকে ভাষার বিকৃতিসহ অশালীন ভাষার ব্যবহার হচ্ছে ইচ্ছেমতো। এসব নোংরামি আমাদের নাটক ও জাতি হিসেবে আমাদের সুনাম ক্ষু্ণ্ন করছে। যারা মনে করে এতে দর্শক বেশি পাওয়া যায়, আয়ের একটা বিষয়ও থাকে। সেটি ভুল এবং সত্যিই অপরাধ। টিভি চ্যানেল কিংবা ইউটিউব চ্যানেলে নাটক নির্মাণ ও প্রচারের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ববোধ থাকা উচিত।

প্রখ্যাত অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, সরকারকে এ ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে যে কোনো চ্যানেলের দায়িত্ববোধ আছে। কারণ এটি একটি পারিবারিকভাবে দেখার মাধ্যম। ইউটিউব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ইউটিউব অবশ্যই ভালো। তবে এর অপব্যবহার গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এতে সমাজ ও তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী এবং আমাদের সংস্কৃতির বড় রকমের ক্ষতি হবে।

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, টিভিতে নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মেনে চললেও ইউটিউবে নেই। ফলে অশালীন ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। যার যোগ্যতা আছে সেও অভিনয় করছে ইউটিউব চ্যানেলের নাটক-ওয়েব সিরিজে, যার নেই সেও করছে। ইউটিউব চ্যানেল একটি নিয়মের মধ্যে আসা উচিত।

অভিনেত্রী বন্যা মির্জা বলেন, আসলে অশালীন ভাষার ব্যবহার শুধু নাটকে নয়, গানেও হচ্ছে। আর এসব প্রচার হচ্ছে ইউটিউব চ্যানেলে, টিভিতে নয়। একশ্রেণির দর্শকও তা দেখছেন। শুধু নাটকের অশালীন ভাষা নিয়ে নয়, গানের অশালীন ভাষা নিয়েও কথা বলা উচিত।

অভিনেত্রী দীপা খন্দকার বলেন, ইদানীং  নাটকের মধ্যে যেভাবে অবক্ষয় ঢুকে পড়ছে তাতে দর্শক ও আমরা শঙ্কিত। এভাবে চলতে থাকলে দর্শক নাটক থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেবে। ইদানীং বিরক্তির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে নাটকগুলোতে অশ্লীল সংলাপ, গালাগালি ও ইশারা-ইঙ্গিতে। যার ফলে টিভি ও ইউটিউবের জন্য নির্মিত নাটকেও সেন্সর বোর্ডের নজরদারি প্রয়োজন আছে বলে দাবি উঠেছে। অনেকে মনে করছেন ইউটিউব এখন টিভি চ্যানেলকে শাসন করছে, প্রভাবিত করছে। টিভিকে পাশ কাটিয়ে ইউটিউবের জন্যও নাটক নির্মাণের হিড়িক বেড়েছে।

নাটক প্রযোজনায় আসছে মিউজিক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো। সেখানে ভিউকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে এখন। আর ইউটিউবের জনপ্রিয়তার চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়েই অল্প ক’জন তারকায় আটকে গেছে নাটক নির্মাণের ভাবনা। এসব নাটকে একটা-দুটা গান ভিডিও আকারে প্রকাশ করার আলাদা ব্যবসাও চোখে লাগছে। অন্যদিকে ইউটিউবের আধিপত্যে নির্মাতারা নিজেদের যোগ্যতা, মেধা ও নির্মাণের মুন্সিয়ানার চেয়ে, গল্পের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন ‘ভিউ’ আনা তারকাদের ওপর। চটকদারি প্রচারণায় ইউটিউবে খানিক সময়ের জন্য ঢুঁ মেরে হয়তো ভিউ বাড়ছে। কিন্তু অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে টিভি চ্যানেলগুলো। এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে খুব।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গেল ঈদের নাটক নিয়ে অনেক হতাশা ঝড়ছে দর্শক ও টিভি মিডিয়ার মানুষদের মধ্যে। তারা ‘সোনা-বাবু’ প্রেম ও অপ্রয়োজনীয় গান-লোকেশন দেখানোর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে নির্মাতাদের অনুরোধ করছেন। ইউটিউবের ভিউয়ের জন্য একই তারকা, সস্তা গল্প ও সংলাপকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশ ও সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে, বিভিন্ন সাফল্য নিয়ে বৈচিত্র্যময় নাটক নির্মাণের পরামার্শ দিচ্ছেন। কেননা এসব অনৈতিক নাটকের ভিড়ে ঠিকই টিভিতে আলোচনায় এসেছে জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, মীর সাব্বিরদের নাটকগুলো। চাকচিক্যের প্রচারণা ছাড়াই ঈদের সেরা অনুষ্ঠান হিসেবে দর্শকের মনে দাগ কেটেছে হানিফ সংকেতের ইত্যাদি এবং নাটক। এটি টিআরপি রেটিংয়ে যেমন ছিল সবার শীর্ষে তেমনি ইউটিউবেও পেয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। সবার প্রত্যাশা টিভি বা ইউটিউব যাই হোক, এতে প্রচারিত অনুষ্ঠান হবে মার্জিত ও পরিশীলিত।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর