শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

যেমন আছেন সেই মিষ্টি মেয়ে কবরী

আলাউদ্দীন মাজিদ

যেমন আছেন সেই মিষ্টি মেয়ে কবরী

‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে ওগো শুধু মোরে, তাই চম্পা বকুল করে গন্ধে আকুল এই জোসনা রাতে তারে মনে পড়ে’- ভালোবাসার এমন আকুতি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে খ্যাত অভিনেত্রী কবরীর মুখেই শুধু মানায়। কবরী অভিনীত প্রথম ছবি ‘সুতরাং’-এর জনপ্রিয় গান এটি। কবরীর নজরকাড়া অভিনয়ের কারণে ছবিটি দর্শকের হৃদয় তোলপাড় করে দেয়। এ ছবিই চট্টগ্রামের কিশোরী মিনা পালকে রাতারাতি অভিনেত্রী কবরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বাংলা ছবি হিসেবে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সুতরাং’ ব্যাপক সম্মান পায়। মানে ‘সুতরাং’ দিয়েই বাংলাদেশি ছবির আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রাপ্তি শুরু। ১৯৬৪ সাল। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত নির্মাণ করবেন ‘সুতরাং’ ছবিটি। এই ছবির জন্য চট্টগ্রাম থেকে আনলেন মিনা পাল নামের একটি কিশোরীকে। সুতরাং ছবিতে অভিনয় করতে গিয়ে মিনা পালের ফিল্মি নাম হয়ে গেল কবরী। সুতরাং মুক্তি পেলে এ ছবি এবং ছবির নায়িকা হিসেবে কবরী দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হন। তারপর জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় কবরীর শুধুই দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলা। একদিকে দক্ষ অভিনয় অন্যদিকে মনকাড়া হাসি দিয়ে সহজেই তিনি দর্শকমন হরণ করেন। তাই দর্শক তাঁকে ‘মিষ্টি মেয়ে কবরী’ আখ্যা দিতে ভোলেননি। ১৯৭৮ সালে শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত ‘সারেং বউ’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন তিনি। পরে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননাও দেওয়া হয় কবরীকে। মিনা পাল ষাটের দশকে চট্টগ্রাম জেলার  বোয়ালখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কবরীর জন্মস্থান বোয়ালখালী হলেও শৈশব ও কৈশোর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম নগরীতে। পিতা শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মা শ্রীমতী লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব কবরীর।

 

কবরীর আত্মকথা

কবরী নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফিরে যান চলচ্চিত্র জীবনের শুরুতে। তিনি বলতে শুরু করেন, যখন চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করি, তখন আমার বয়স মাত্র ১৩ বছর। ক্লাস সিক্সে পড়ি। সুভাষ দত্ত একটা কিশোরীর ভূমিকার জন্য খুঁজে আমাকে পেয়ে যান। সাংস্কৃতিক পরিবারে মানুষ হয়েছি। মা পুঁথি পড়তেন, ভাইবোনেরা নাচতেন-গাইতেন, ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। আমি নাচ করতাম। তবে আগে অভিনয় করিনি। যখন অফার  পেলাম, তখন বাবা খুবই উৎসাহিত হলেন। মা দিতে চাননি। তিনি বললেন, ওর পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাবে। পরিবার একটু রক্ষণশীল তো ছিলই। আমার মায়ের  ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যায়। তিনি অনেকদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। তাই তাঁর খুব শখ ছিল মেয়েকে পড়াবেন। আমি সুভাষ দত্ত, ফজলে লোহানী, খান আতা, জহির রায়হান থেকে অভিনয় শিখেছি। এখন তো সেরকম শিক্ষকও নেই।

কবরী দুঃখ করে বলেন, অভিনয়ের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অবশ্যই দরকার। এখন অবশ্য কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ক্রিপ্টিং, অভিনয় করায় কিন্তু আমার মনে হয় না, তাতে কিছু হয়। এখানে পর্যাপ্ত উপকরণ নেই। সে ধরনের সরকারি সহযোগিতাও পাওয়া যাচ্ছে না। কিংবা যাঁরা জানে, তাঁদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে না। ভারতীয় চলচ্চিত্র যদি দেখি, তারা কি সব ছবি ভালো বানায়? না। তারা এখন শিল্প হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। অথচ আমাদের এফডিসিকেও বলা হয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেই। সরকারিভাবে যে অনুদান  দেয়, তা পছন্দমতো লোককে দেওয়া হয়। সেই ছবি মানুষ দেখতেও পায় না। কোথায় কোন হলে চলে, সেটা মানুষ জানতেও পারে না। বণ্টনটা পকেটস্থ করার একটা ধ্যান-ধারণা হয়ে গেছে। এখানে যে উন্নয়ন দরকার, তা মন্ত্রী হয় বুঝতে পারেন না বা তাঁর ইচ্ছা নেই। এমনিতে আমি আশাবাদী, আমি স্বপ্ন দেখি, কিন্তু স্বপ্ন দেখতে  দেখতে তো দিন চলে যাবে। আমার জন্য তো সময় বসে থাকবে না। আমি যদি স্বপ্ন দেখতে থাকি, বাস্তবতায় রূপ না দিই, তাহলে তো কিছুই হবে না।

 

এখন যেমন আছেন...

জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম বর্তমান সময়ে বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে তাঁর জীবন কেমন কাটছে। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন, আসলে বলার কিছু নেই, এই মহামারী নিয়ে ডিপ্রেসড হলেই সব শেষ। কাজে যেতে ভয় হয়। বেশির ভাগ সময়ই অনেককেই ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হয়। বলা হচ্ছে মানুষ সচেতন হচ্ছে না বলেই করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। আমি বলব সচেতনতা তৈরির মতো প্রপারলি কাজ করছেন না দায়িত্বশীলরা। রেডিও-টিভিতে যে পাবলিসিটি চালানো হচ্ছে তা কি ঠিক হচ্ছে? বলতে গেলে ভয় মিশ্রিত প্রচারণা চালাতে গিয়ে মানসিকতা নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। টিভি-রেডিও খুললেই করোনা নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনতে শুনতে একদিকে মানুষ আতঙ্কিত, অন্যদিকে বিরক্ত হচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন সরকার এবং জনপ্রতিনিধিদের এলাকাভিত্তিক কাউন্সিলিং। কারণ সবাই তো শিক্ষিত নয়। আবার করোনা প্রতিরোধে যা প্রয়োজন এবং শরীরের সক্ষমতা বাড়াতে যে খাদ্য দরকার দরিদ্র মানুষের পক্ষে তা কেনা সম্ভব নয়। সরকার এবং জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি  বিত্তবানদেরও এদের সেবায় বিপুলভাবে এগিয়ে আসতে হবে। গত বছরের ১৭ মার্চ আমার পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি ‘এই তুমি সেই তুমি’র শুটিং শুরু করেছিলাম। করোনার কারণে বার বার কাজ বন্ধ রাখতে গিয়ে সময়মতো নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারাছি না। এখন বাসায় বসে দেশ জাতি আর ব্যক্তিগত নানা বিষয় নিয়ে শুধু ভাবছি, কি করব বুঝতে পারছি না। এমন দম বন্ধ অবস্থায় লেখালেখিতেও মন বসছে না। সব শেষে বলতে হয় করোনা আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই। প্রকৃতির বিপরীতে হাঁটতে গেলে প্রকৃতি এর নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেবেই। তাই সবার নিয়মতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া উচিত।

সর্বশেষ খবর