লকডাউন উঠে গেছে। শনাক্ত ও মৃত্যুর হারও কমে গেছে। অফিস-আদালত আর শপিং মল থেকে শুরু করে সব ধরনের গণপরিবহন সচল। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সচল হয়নি সংস্কৃতির চাকা। ১১ আগস্ট থেকে লকডাউনের খড়গ উঠে যাওয়ার পর ১৯ আগস্ট থেকে বিনোদন কেন্দ্র ও পার্ক খুলে দেওয়া হলেও এখনো কার্যত বন্ধ সংস্কৃতির মঞ্চগুলো। যার কারণে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন এই অঙ্গনের মানুষজন। শিল্পীদের শিল্পের নান্দনিক বহিঃপ্রকাশে যাঁরা যুক্ত আছেন তাঁদের কষ্টের পরিমাণটা একটু বেশি বলেই জানিয়েছে শিল্পাঙ্গনের মানুষজন। বিশেষ করে নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত যন্ত্রশিল্পীদের যাপিত জীবনে এখন করোনার মতোই দুর্যোগ চলছে বলে জানান ভুক্তভোগীরা। যে তানপুরার সুরে আলোড়িত হতো শ্রোতা সেই তানপুরায় এখন ধুলা জমেছে, যে গিটারের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ত মিলনায়তনজুড়ে সেই গিটারের তারগুলোতে এখন জং ধরেছে, আর যে বাঁশির সুরে বিগলিত হতো সুরানুরাগীদের হৃদয় সেই বাঁশি এখন পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। তানপুরা, গিটার আর বাঁশির মতোই অবহেলিত যন্ত্রশিল্পীদের জীবন। তাল, লয় আর ছন্দ অবসর নেওয়ায় যন্ত্রশিল্পীদের জীবনেও ছন্দপতন দেখা দিয়েছে। প্রায় দেড় বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি সব অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় খেয়ে-না খেয়ে কঠিন সময় পার করছেন তবলচি, গিটারিস্ট, বাঁশিওয়ালাসহ সব যন্ত্রী। কথা প্রসঙ্গে বেশ কয়েকজন যন্ত্রশিল্পী জানান, তাঁদের ধারণা ছিল ভাইরাসের বিষে বিষাক্ত ২০২০ সালের পর ২০২১ সালে তাঁদের রোজগারের চাকাটা সচল হবে। কিন্তু বিধিবাম। দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার পর ফের লকডাউনে তাঁদের জীবনে আবারও নেমে আসে শনির দশা। লকডাউন শেষ হলেও বিষাক্ত এই ভাইরাসের কারণে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি যন্ত্রশিল্পী বর্তমানে কষ্টের দিন পার করছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র। দীর্ঘদিনের চর্চিত এই পেশা ছেড়ে অন্ন-বস্ত্রের সন্ধানে অনেকে এখন ভিন্ন পেশায় যোগ দিয়েছেন এমন খবরও জানিয়েছে একাধিক সূত্র। আবার কেউ কেউ এখনো তাকিয়ে আছেন সরকারি সাহায্যের দিকে।
৫০ বছর যাবৎ বাঁশি বাজানোর কাজে যুক্ত মো. হাসান আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনা আমাদের মেরে ফেলেছে। দেহটা কোনোভাবে টিকে আছে। মন মরে গেছে। খুব অভাবে আছি। এর থেকে মৃত্যুও অনেক ভালো। খেয়ে না খেয়েই দিন পার করছি। জমানো যা ছিল তাও শেষ। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে চলব পথ দেখছি না। এক বছর ধরে বাড়ি ভাড়াও দিতে পারছি না।
ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রবীণ এই বংশীবাদক আরও বলেন, আমি একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের সঙ্গে বাঁশি বাজিয়েছি এবং সে সময় বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাকেও বাঁশি বাজিয়ে শোনাতাম। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমার নাম নেই।
বাংলাদেশ বেতার ও বিটিভির ‘এ’ গ্রেডের তালিকাভুক্ত এবং রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত বেহালাশিল্পী সুনীল চন্দ্র দাশ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মুঠোফোনে অসুস্থ এই শিল্পী বলেন, টিউশনিসহ সব অনুষ্ঠান আয়োজন বন্ধ থাকায় জমানো টাকা ভেঙে এতদিন চলেছি। অসুস্থতার কারণে এখন চরম বিপদে পড়ে গেলাম। চোখে অন্ধকার দেখছি।
৪০ বছর যাবৎ তবলা বাজানোর কাজে যুক্ত স্যামসাং সরকার বলেন, প্রতি মাসে সাতটি টিউশনি করতাম। দেড় বছর ধরে সব বন্ধ। না খেয়ে বাড়ি ভাড়া শোধ করতে হচ্ছে। আমরা যন্ত্রশিল্পীরা এমনিতেই অবহেলিত। তার ওপর করোনার ছোবলে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম।
হতাশ কণ্ঠে দোতারা বাদক অরূপ কুমার শীল বলেন, ৩০ বছর যাবৎ দোতারা বাজাই, সবাই চিনে-জানে। যার কারণে না পারছি রিকশা চালাতে, না পারছি হাত পাততে। দেড় বছর ধরে টিউশনি থেকে শুরু করে সবকিছুই বন্ধ। জীবনকে আর সামনের দিকে টেনে নিতে পারছি না। এ পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে কি-বোর্ডিস্ট ডালিম কুমার বড়ুয়া বলেন, গত দেড় বছরে কেউ একবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি। কষ্ট চেপে রাখতে রাখতে শিল্পীসত্তা মরে গেছে, চলে গেছে মনের শান্তি। জমানো টাকা ভেঙে চলতে চলতে সবই শেষ হয়ে গেছে। কষ্টই এখন আমার জীবনসঙ্গী।
৩০ বছর ঢোল বাজিয়ে মানুষকে বিনোদিত করা মো. স্বপন মিয়া বলেন, খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। ধার-দেনায় চলছি। বাড্ডায় ভাড়া থাকতাম কিন্তু ভাড়া দিতে পারছি না বলে শনির আখড়ায় চলে এসেছি কম ভাড়ায়। পরিবার নিয়ে খুবই কষ্টে কাটছে আমার দিনকাল।