নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন আজ। তাঁর পরিচালিত নাটক-চলচ্চিত্রের নিয়মিত মুখ হিসেবে রঙিন ভুবনে পরিচিত পান অভিনেতা ডা. এজাজ। শোবিজে এই গরিবের ডাক্তার কুড়িয়েছেন নাম-যশ-খ্যাতি। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন ও বিভিন্ন বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল
কেমন আছেন। শুটিংয়ে যাচ্ছেন? নাকি চেম্বারে।
আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। নাহ শুটিংয়ে নয়, চেম্বারের পথে এখন। আমি সব সময় তিনটি বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকি- চেম্বার, অভিনয় ও সংসার। মাসে ১৮ দিন রাখি চেম্বারের জন্য। বাকি ১২ দিন করি শুটিং। ২১-২২ ঘণ্টা কাজ করি; মাত্র ২-৩ ঘণ্টা ঘুমাই। কম ঘুম যদিও ক্ষতিকর। পেশায় চিকিৎসক বলে হুমায়ূন আহমেদ শুটিংয়ের সময় আমার সময়সূচিকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন। খেয়াল রেখেছেন নাটক করতে গিয়ে যেন কোনো রোগীর ক্ষতি না হয়। আর সে কারণেই রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে অভিনয় চালিয়ে গেছি। আর সব নির্মাতাকেই বলি, ভাই আমার সময় কিন্তু কম। আমাকে নিলে আপনার এই ঝামেলা পোহাতে হবে। ফ্রি সময়ের মধ্যে কাজটুকু শেষ করে ফেলতে হবে। তারা কিন্তু আমার প্রতি এই মমতাটুকু দেখান।
অভিনয় নাকি পেশা-কোনটাকে এগিয়ে রাখেন?
পেশার সঙ্গে আমি অভিনয়টাকে খুবই এনজয় করি। পেশা আর নেশায় তাই কখনো সমস্যা হয়নি। আর সামান্য যেটুকু অভিনেতা হয়েছি, সেটি করতে পারতাম না, যদি স্যারের সঙ্গে কাজ না করতাম। তবে যদি কোনোটিকে ছাড়তে বলা হয় তাহলে বোধ হয় অভিনয় ছেড়ে দেব। আমি আগে ডাক্তার, পরে অভিনেতা। একবার ১৫ দিন অসুস্থ হয়েছিলাম। রোগীরা অনেক দোয়া করেছিল। তাদের ভালোবাসাটা অন্যরকম। ‘শ্যামল ছায়া’র শুটিং যখন করতাম, প্রতিদিন রোগীরা খাবার নিয়ে আসত। একবার হুমায়ুন স্যার বললেন, ‘ও এত খাবার পায় কোথা থেকে।’ তখন অন্যরা বলেছিলেন, ‘তার রোগীরা খাবার দিয়ে যায়।’ এটাই ভালোবাসা।’
আজ হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তাকে নিয়ে কিছু স্মৃতি শেয়ার করবেন?
মৃত্যুর পর স্যারের জন্মদিনেও অন্য সবার মতো আনন্দ করতে পারি না। কারণ, মৃত পিতার জন্মদিনে সন্তানের উচ্ছ্বাস মানায় না। স্যারের পরিচালনায় প্রথমবারের মতো অভিনয় করেছিলাম ‘সবুজ সাথী’ নাটকে, স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মী হিসেবে। চরিত্র ছিল ছোট। এর পর থেকেই স্যারের প্রায় সব নির্মাণেই থাকতাম। আর তাঁর সঙ্গে প্রথমবার চলচ্চিত্র করি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। নির্মাণের নানা কাজেও স্যার আমার ওপর ভরসা রাখতেন। শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের সময় দেখি স্যারের ঠিক করা লোকেশনে গিয়ে শুটিং সম্ভব না। কিন্তু ‘স্যার’কে বলতেও পারছিলাম না ব্যাপারটা। তাই তাকে দুশ্চিন্তায় না ফেলে মুহূর্তের মধ্যেই শুটিং লোকেশন ঠিক করে ফেলি। আমার কাজে অবাক হয়ে তিনি তখন ‘গুড জব ডাক্তার’ বলে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাহবা দিয়েছিলেন। আবার নুহাশ পল্লীর জন্য জায়গা দেখতে গিয়ে এক রিকশায় স্যারের সঙ্গে গ্রামের রাস্তায় চলার কথা ভুলিনি। সে দিনই প্রথম জেনেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে স্যার অনেক পছন্দ করতেন। সেদিন খাবার তালিকায় ইলিশ মাছ দেখে দারুণ খুশি হয়েছিলেন স্যার। আসলে স্যারকে খুশি করা খুব সহজ ছিল। শুটিং চলাকালীন বা শুটিং শেষে একই রকম মানুষ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সব সময় সবার খেয়াল রাখতেন। তার কাছে সবচেয়ে অপছন্দের বিষয় মিথ্যা কথা বলা।
হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় কাজের মধ্যে কোন কাজটি সবচেয়ে প্রিয়?
আলাদা করে কোনোটির নাম বলা সম্ভব নয়। যত কাজই করা হোক না কেন, যত ভালো কাজই হোক, স্যারকে সব স্থানেই খুঁজে বেড়াই।
আপনার স্যারের কোনো ইচ্ছে ছিল, যা পূরণ হয়নি?
একটি ক্যান্সার হাসপাতাল করার ইচ্ছে ছিল।
নাট্যজগতে হুমায়ূন আহমেদের শূন্যতা কতখানি?
শূন্যতা তো পূরণ হওয়ার নয়। স্যার ছিলেন নির্লোভ মানুষ। যা করতে ইচ্ছে হতো তিনি তা বিশাল করে করতেন। মনের আনন্দের জন্য, মনের প্রশান্তির জন্য তিনি সবই করতেন। শ্রাবণ মেঘের দিন বা দুই দুয়ারীর শুটিংয়ের আয়োজন ছিল বিশাল। দুই দুয়ারী যদি তিন মাস টানা চলত তাহলে সে সময় তিনি ২০-৩০ কোটি টাকা ব্যবসা করতে পারতেন। তিনি নির্লোভ বলেই সেই চিন্তা করেননি। তিনি যেভাবে নাটক করতেন সেভাবে লেখা আর ডিরেকশন দেওয়া এখন আর ওই পর্যায়ের কাছাকাছিও কেউ নেই। বিশেষ করে হাসির নাটক তো না-ই। হাসির নাটক মানে এখন হয়ে গেছে চিৎকার চেঁচামেচি, ভাঁড়ামি, লোক ঠকানো, মিথ্যা শেখানো, জোর করে হাসানোর চেষ্টা। এখন আর ওই ধরনের নাটকও নেই, ওই শ্রেণির দর্শকও নেই।
ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা আগের স্থানে নেই কেন?
আসলে সে কাজ আর নাই। কাজের যে আনন্দ, যে উচ্ছ্বাস সেটা এখন আর নাই। হুমায়ূন স্যার যখন কাজ করতেন দেখেছি তার একটা টার্গেট ছিল, একটা ভালো কাজ করব। অর্থ কী পাব কী পাব না-সেটা নিয়ে ভাবেননি। এখন আমরা নাটক করতে গেলে ছবি করতে গেলে আগে টাকার অঙ্ক নিয়ে বসি। উনি বলতেন, কত সুন্দর ছবি করব, দর্শক আমার ছবি কতটা উপভোগ করবে। এখনকার টার্গেটই তো অন্যরকম। এখন অঙ্কটা লাভের, অঙ্কটা কাজের না।
হাসির মন্ত্রটা কীভাবে রপ্ত করলেন?
আসলে এ সবই সংলাপের ক্রেডিট বলা চলে। তবে মানুষকে ‘হাসানো কঠিন; কিন্তু কাঁদানো সহজ।
টিভিতে কোন কোন কাজ প্রচার হচ্ছে?
নাটক ‘অক্টোপাস’, দীপ্ততে সাজ্জাদ সুমনের ‘মাশরাফি জুনিয়র’, আরটিভিতে হিমু আকরামের ‘শান্তি মলম ১০ টাকা’, সঞ্জিত সরকারের ‘চিটার অ্যান্ড জেন্টলম্যান’। এ ছাড়াও অভিনয় করেছি আল হাজেন, কায়সার আহমেদসহ বেশকিছু নির্মাতার নির্মাণে।
ওয়েব সিরিজে অভিনয়...
একটি করেছিলাম। নাম সাবরিনা। তাও আশফাক নিপুণের অনুরোধে। বড় চরিত্র ছিল। তবে সে সময় স্ত্রী অসুস্থ হওয়ার কারণে শুটিংয়ে খুব বেশি সময় দিতে পারিনি।
সামনে কোনো সিনেমায় দেখা যাবে?
নাহ, আপাতত কোনো সিনেমায় অভিনয় করিনি।