মঙ্গলবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

ঢাকাই ছবিতে অবিশ্বাস্য যত প্রথম

ঢাকাই ছবিতে অবিশ্বাস্য যত প্রথম

ঢাকার ছবিতে প্রথম হেলিকপ্টার ব্যবহার হয় বেদের মেয়ে ছবিতে ১৯৬৮ সালে

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বকীয় নির্মাণ যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সালে এফডিসির গোড়া পত্তনের পর পরই। তখনকার সময়ে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখানে চলচ্চিত্র নির্মাণ অতটা সহজ ছিল না। তারপরও কিছু সিনেপ্রেমী ব্যক্তিত্বের অদম্য ইচ্ছা শক্তির কারণেই এক সময় সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ বিশ্ব দরবারে নাম লেখায়। এ বিষয়ে কিছু শুরুর গল্প তুলে ধরেছেন - আলাউদ্দীন মাজিদ

 

প্রথম হেলিকপ্টার ব্যবহার

পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কাব্যনাট্য অবলম্বনে নির্মিত ‘বেদের মেয়ে’ ছবির চিত্রায়ণের জন্য বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে প্রথম ব্যবহার হয় হেলিকপ্টার। তখনকার সময়ে যা ছিল অকল্পনীয়। পুরনো পত্রিকার কাটিং ও ছবি সামনে এনে বিষয়টি তুলে ধরেন চলচ্চিত্রবিষয়ক গবেষক মীর শামসুল আলম বাবু। পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কাব্যনাট্য অবলম্বনে নুরুল হক বাচ্চুর ‘বেদের মেয়ে’ ছবির মহরত ও শুটিং হয় ১৯৬৮ সালে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে। ছবির চিত্রায়ণের জন্য ব্যবহার হয় হেলিকপ্টার। বাবু জানান, শুরুতে কবিপুত্র কামাল আনোয়ারের পলাশ ফিল্মসের ব্যানারে এম মহসীনের চিত্রনাট্যে পরিচালক কিউ এম জামান ১৯৬৮ সালের ১৪ মে ‘বেদের মেয়ে’ ছবির মহরত করেন। সুলতানা জামানকে নায়িকা করে কিছু শুটিং করেছিলেন, সেখানে জহির রায়হানও উপস্থিত ছিলেন। পরে জহির রায়হানের চিত্রনাট্য ও প্রযোজনায় আনিস ফিল্মসের ব্যানারে কামাল আনোয়ারের চিত্রায়ণে নুরুল হক বাচ্চুর পরিচালনায় রোজী, সুজাতা ও আজিমকে নিয়ে এ ছবি সমাপ্ত হয়। বাবু বলছিলেন, ‘বেদের মেয়ে’ ছবির আউটডোর শুটিংয়ে টপ শট নেওয়ার জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার হয়েছিল। এটাই এ দেশের ছবির শুটিংয়ে প্রথম হেলিকপ্টার ব্যবহার।

 

ফার্স্ট লেডি ‘সুমিতা দেবী’

যার হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে নায়িকার প্রচলন শুরু হয় তিনি সুমিতা দেবী, যাকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ফার্স্ট লেডি।’ ওই আমলে কোনো বাঙালি মুসলিম মেয়ে চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন তা ছিল অবিশ্বাস্য। সুমিতার প্রকৃত নাম হেনা ভট্টাচার্য। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর নাম হয় নিলুফার বেগম। সুমিতা দেবী নামটি পরিচালক ফতেহ লোহানীর দেওয়া ‘আসিয়া’ ছবিতে। কালজয়ী পরিচালক জহির রায়হান তার স্বামী। প্রথমবার বিয়ে হয়েছিল কলকাতার বামপন্থি নেতা অতুল লাহিড়ীর সঙ্গে এবং সে বিয়ে বেশি দিন টেকেনি। কৈশোরেই প্রচলিত সমাজের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন সুমিতা দেবী। তার পরিবারে এক মেয়ে বিধবা হওয়ার পর তার লাইফস্টাইলে যে পরিবর্তন আসে তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এ জন্য পরিবারের সঙ্গে তার বাগবিতণ্ডা হয়েছিল। তবে এখান থেকেই জীবনে কিছু একটা করে দেখানোর জিদ হয়েছিল তার। চলচ্চিত্রে কাজ করার সাহস সেই জিদেরই পরবর্তী ধাপ এবং তিনি সফল হন। ১৯৫৭ সালে ঢাকায় ছবি নির্মাণ হচ্ছে শুনে তার ইচ্ছে জাগে অভিনয়ের। এ জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’য় তার নায়িকা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা থাকার কারণে ওই ছবিতে তার অভিনয় করা হয়নি। ‘আসিয়া ছবির আগেই সুমিতা অভিনীত ‘আকাশ আর মাটি’ (১৯৫৯) এবং ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পেয়েছিল। তবে ‘আসিয়া’ ছবিতে সুমিতা ছিলেন নায়িকার নাম ভূমিকায়। ১৯৭১ সালে কলকাতায় থাকাকালে উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘শ্রী শ্রী সত্য শাহী বাবা’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন সুমিতা দেবী।

 

এফডিসির প্রথম ছবি ‘আসিয়া’

এফডিসিতে শুটিং করা প্রথম ছবি হলো ‘আসিয়া’। এটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালের ৪ নভেম্বর। ১৯৫৭ সালে গঠিত হয় এফডিসি। সে বছরের ২০ মে সেখানে প্রথম শুটিং হয় ‘আসিয়া’ ছবির। ছবিটির কাজ অবশ্য শুরু হয়েছিল আগেই। বছরের শুরুতে। সরকারি প্রচার দফতরের উদ্যোগে। তবে প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে। নাম ছিল ‘লাইফ ইন ইস্ট পাকিস্তান’। এরই মধ্যে যাত্রা শুরু করে এফডিসি। এর বছর দুই আগেই পশ্চিম বঙ্গে মুক্তি পায় সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫)। যাকে বলা হয় পূর্ণাঙ্গ টেক্সট ফিল্ম। এফডিসির শুরুতেও তেমনই একটা ছবি বানানোর কথা ভাবেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাজির আহমেদ। সেই ভাবনা থেকেই ‘লাইফ ইন ইস্ট পাকিস্তান’-এর পরিকল্পনা বদলে ফেলা হয়। কাহিনি ও সংলাপ নাজির আহমদ নিজেই লেখেন। প্রযোজক নূরুল ইসলাম। পূর্বাণী চিত্রের ব্যানারে ছবিটির নাম রাখা হয় ছবির নায়িকা চরিত্রের নামে ‘আসিয়া’। ২০ মে ১৯৫৭। ‘আসিয়া’র দৃশ্য ধারণ শুরু হয়। এফডিসিতে সেই প্রথম কোনো সিনেমার শুটিং। কিন্তু শেষ আর হয় না। দফায় দফায় ছবির কাজ বন্ধ হতে থাকে। কখনো টাকার অভাবে। কখনো অন্য কারণে। নির্মাতা ফতেহ লোহানী নিজেও হতাশ হয়ে পড়েন। শুরু করেন অন্য ছবির কাজ। ‘আকাশ আর মাটি’। প্রায় একই কলাকুশলী নিয়ে। শেষ করে মুক্তিও দেন ১৯৫৯ সালের ২৪ জুলাই। তা ছিল এফডিসিতে গৃহীত ও পরিস্ফুটিত প্রথম ছবি। দীর্ঘ আড়াই বছরে শেষ হয় ছবির কাজ। জমা দেওয়া হয় সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য। কিন্তু সেখানেও দীর্ঘসূত্রতা পিছু ছাড়ে না। কয়েকটি দৃশ্যের ব্যাপারে আপত্তি তোলেন বোর্ডের সদস্যরা। ছবিতে নায়ক-নায়িকা ছোটবেলায় ছিল খেলার সাথী। বড় হতে হতে তাদের মধ্যে প্রেম হয়ে যায়। কিন্তু নায়িকার বিয়ে হয় চাচার সঙ্গে। তারপরও নায়ক-নায়িকা চালিয়ে যায় অভিসার। আর সেখানেই বোর্ডের সদস্যদের আপত্তি। তারা নায়ক-নায়িকার গোপন প্রেমের দৃশ্যগুলো ফেলে দিতে বলেন। কিন্তু রাজি হননি ফতেহ লোহানী। তাহলে গল্পের বাস্তবতা ক্ষুণœ হবে। ঝামেলা মেটাতে আরও সময় লেগে যায়। শেষ পর্যন্ত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬০ সালের ৪ নভেম্বর। সমালোচকদের প্রশংসা তো বটেই, ছবিটি সে বছর প্রেসিডেন্ট পুরস্কারও পায়। ১৯৬১ সালে অংশ নেয় নয়াদিল্লি চলচ্চিত্র উৎসবে। ছবিটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ১ লাখ ৯২ হাজার টাকা। আর আয় করেছিল ৩৫ হাজার।

 

রাজনৈতিক গল্পের চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’

রাজনৈতিক ঘটনায় এ দেশে প্রথম চলচ্চিত্র জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০)। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে মাইলফলক হয়ে রয়েছে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি অগণতান্ত্রিক সরকার এ চলচ্চিত্রটি মুক্তি দিতে গড়িমসি করলে রাজপথে মিছিল হয়। এক পর্যায়ে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গণচেতনার প্রতিফলন হিসেবে এই চলচ্চিত্রটি উল্লেখযোগ্য নির্মাণ।

 

শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘সান অব পাকিস্তান’

ফজলুল হক পরিচালিত ‘সান অব পাকিস্তান’ (১৯৬৬)-ই এ দেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র এটি। বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পরে ড. আশ্রাফ সিদ্দিকীর স্কুলপাঠ্য গল্প গলির ধারের ছেলেটির চলচ্চিত্রায়ণ করেন খ্যাতিমান পরিচালক সুভাষ দত্ত। ছবিটির নাম ছিল ‘ডুমুরের ফুল’।

সর্বশেষ খবর