সত্তর ও আশির দশক ছিল বাংলাদেশে টিভিনাটকের সোনালি সময়। তখন এ দেশে ঘরোয়া বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল টিভিনাটক। পরিতাপের বিষয়, নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে টিভিনাটক হারিয়েছে কৌলীন্য। কতিপয় নামসর্বস্ব নির্মাতা যারা স্বঘোষিত বোদ্ধা তারা নাটকের নামে বাংলা ভাষার অপব্যবহার, আঞ্চলিক ও অশ্লীল ভাষার প্রয়োগ, যেনতেন নির্মাণ এবং অদক্ষ অভিনয় দিয়ে টিভিনাটকের সর্বনাশ করেছেন। এখন টিভিনাটক মানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সস্তা বিনোদন। তাই দর্শকও এখন টিভিনাটকবিমুখ। যা একটি নিজস্ব সংস্কৃতি সমৃদ্ধ জাতির কাছে কাম্য হতে পারে না। এখনকার প্রায় নাটকের সংলাপ খাইসি, গেছি টাইপের হয়ে গেছে। মানছি যে আমরা দৈনন্দিন জীবনে এ ভাষায় কথা বলি, কিন্তু তাই বলে নাটকের ক্ষেত্রে এভাবে সংলাপ বললে কি সেটা শ্রুতিমধুর লাগে? দর্শকদের কথায়- আগে টিভিতে প্রচারিত নাটকের অভিনয় শিল্পীদের সংলাপ থেকে আমরা কথা বলার স্টাইল শিখতাম। অতীতের নাটকের সংলাপ থেকে ভাষা শেখার অনেক বিষয়ই ছিল। কিন্তু এখনকার টিভির নাটক বা অন্য অনুষ্ঠানের শিল্পীদের সংলাপ শুনে তরুণ প্রজন্ম কী শিখবে? যেমন আবার জিগায়, ফাঁপরের মধ্যে আছি, দৌড়ের মধ্যে আছি, পুরাই পাঙ্খা- এসব ভাষা এখন বাচ্চারা শিখছে। এই যদি হয় টিভিনাটকের দশা তবে তা কার ভালো লাগবে? দর্শকদের কথায়- আমরা চাই অতীতের মতো প্রাণময় প্রমিত ভাষার নাটক। অনেকে বলছেন, ভাইরালের নেশা যেন টিভিকেও পেয়ে বসেছে। জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আবদুল্লাহ রানা বলেন, আগেকার নাটকে ছিল পারিবারিক বন্ধন, শালীন ভাষা ও সামাজিক শিক্ষা। সবকিছু মিলিয়ে নাটক হয়ে উঠেছিল জীবনেরই একটি অংশ। তবে এখনকার অধিকাংশ নাটক হয়ে উঠেছে সস্তা বিনোদনের অনুষঙ্গ। সবাই যেন ছুটছে ভাইরালের নেশায়। যে ভাইরাস নাট্য ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি করেছে সামাজিক অবক্ষয়। যে অবক্ষয়ের মধ্যে আছে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় দক্ষতার অভাব, অশালীন ভাষা, ভালো গল্পের অভাব ও বাজেটের স্বল্পতা। সবকিছু মিলিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে নাট্য ইন্ডাস্ট্রি। একটি নাটক বা অনুষ্ঠান দর্শকদের সামনে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলে ভাষা। বিকৃতির বিষয়টি এখন ভাষায় আটকে নেই। এটি এখন কনটেন্টে আটকে আছে। ভাষার বিকৃতি এখন অনেকাংশে ভাঁড়ামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। খুব কম নাটকেই দেখা যায় সঠিক বাংলা ভাষার ব্যবহার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে শুদ্ধ ভাষাকে মিলিয়ে নতুন এক ধরনের ভাষা তৈরি করে কথা বলছে একটি দল। অভিনেত্রী দিলারা জামান বলেন, ‘আসলে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখে না। তাই অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার বিকৃতিটাকে তেমন কিছু মনে হয় না অনেকের কাছে। আমাদের মনে রাখা উচিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমরা যে কোনো মাধ্যমে যা-ই করি না কেন সেখানে শুদ্ধরূপে প্রমিত বাংলার ব্যবহার থাকা উচিত।’ ষাট থেকে আশির দশক পর্যন্ত বিটিভির ডিআইটি ভবন থেকে সরাসরি নাটক সম্প্রচার করা হতো। তখনকার নাটক মানেই তুমুল জনপ্রিয়তা। নাটকের জন্য রাজপথে মিছিল পর্যন্ত হয়েছিল। সোনালি দিনের নাটক প্রচারের সময় রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। নাটকের এতটাই দর্শক ক্রেজ ছিল একসময়। তখনকার নাটকগুলো কালজয়ী হয়ে আছে। এমন সব দর্শকপ্রিয় নাটকের তালিকায় অনায়াসে যে নামগুলো চলে আসে তা হলো- ‘এই সব দিন রাত্রি’, ‘সংশপ্তক’, ‘মাটির কোলে’, ‘জোনাকী জ্বলে’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘এখানে নোঙর’, ‘ঢাকায় থাকি’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘অয়োময়’, ‘বহুব্রীহি’, কোথাও কেউ নেই’ প্রভৃতি। তখনকার নাটকের সংলাপও মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘বহুব্রীহি’ নাটকের ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি একসময়ে মানুষের মুখে মুখে ফিরত। ‘তুই রাজাকার’ সংলাপটি টিয়া পাখির মুখ দিয়ে বলানো হয়েছিল টিভিনাটকে। নাটকটির অভিনয়শিল্পীরা নাটকের নাট্যকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ পেয়েছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন নওয়াজীশ আলী খান। ‘সংশপ্তক’, বিটিভির ইতিহাসে এ নাটকটির জনপ্রিয়তা ছিল শীর্ষে। এ নাটকে ফেরদৌসী মজুমদার ও হুমায়ুন ফরীদির অভিনয়ের কথা এখনো মনে রেখেছেন দর্শক। হুমায়ুন ফরীদি এ নাটকে ‘কানকাটা রমজান’ চরিত্রে এবং ফেরদৌসী মজুমদার ‘হুরমতি’ চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় এসেছিলেন। এ ছাড়াও খলিলউল্লাহ খলিল ‘মিয়ার বেটা’ চরিত্রে অভিনয় করে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ‘সংশপ্তক’ নাটকটি শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস থেকে নাট্যরূপ দিয়েছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। প্রযোজনা করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আরও একটি জনপ্রিয় নাটক হলো- ‘মাটির কোলে’। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন মুসা আহমেদ। মিষ্টি মেয়ে খ্যাত চলচ্চিত্র নায়িকা কবরী এই ধারাবাহিক নাটকের মধ্য দিয়ে প্রথমবার কোনো দীর্ঘ ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের কথা কি দর্শকরা ভুলতে পেরেছেন? নাটকটির নাট্যকার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এটি প্রযোজনা করেছিলেন বরকত উল্লাহ। একটি নাটকের চরিত্র দর্শকদের কাছে কতটা আপন হতে পারে তা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের বাকের ভাই চরিত্রটি দেখলেই টের পাওয়া যায়। বাকের ভাইয়ের যখন ফাঁসি হবে তখন এ দেশের শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন মিছিল করার জন্য, যাতে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না দেওয়া হয়। টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে ‘কোথাও কেউ নেই’ একটি মাইলফলক। ‘এই সব দিন রাত্রি’ ধারাবাহিকটির কথাই বা বাদ যায় কী করে? সৌভাগ্যবশত এই নাটকটির নাট্যকারও ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। বাংলাদেশের টিভিনাটকের ইতিহাসে নাট্যকার হিসেবেও সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘এই সব দিন রাত্রি’ নাটকের শিমু ভাবির চরিত্রটি ওই সময়ে বহু মানুষের স্বপ্নের একটি চরিত্র ছিল। শিমু ভাবির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ডলি জহুর। সে সময় ডলি জহুরকে অনেকেই শিমু ভাবি নামেই ডাকতেন। নাটকের টুনি চরিত্রে অভিনয় করা শিশু শিল্পী লোপাকে আজও ভোলেননি দর্শক। ‘জোনাকী জ্বলে’ ধারাবাহিকটিও ছিল টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে আলোচিত। জিয়া আনসারী প্রযোজনা করেছিলেন নাটকটি। ইমদাদুল হক মিলনের লেখা ‘রূপনগর’ টেলিভিশন নাটকের ইতিহাসে আরও একটি সফল, আলোচিত এবং জনপ্রিয় নাটক। নাটকটির ‘ছিঃ ছিঃ তুমি এত খারাপ’ সংলাপটি ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। খালেদ খান নতুনভাবে দর্শকদের সামনে আসেন ‘রূপনগর’ নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। ইমদাদুল হক মিলনের ‘বারো রকম মানুষ’ ধারাবাহিকটিও সে সময় দর্শকদের মনে দারুণভাবে দাগ কাটে। ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ও সে সময়ের নাটকগুলোর মধ্যে আলোচিত। এ নাটকে সেরাজ তালুকদারের চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন খলিল। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ। ‘সকাল সন্ধ্যা’ সে সময়ের আলোচিত ও উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে অন্যতম। নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন বরকত উল্লাহ।
নাট্যকার ছিলেন মমতাজ বেগম। ‘সকাল সন্ধ্যা’য় অভিনয় করে তখন অনেকেই তারকা বনে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম হলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আফরোজা বানু। নাট্যজন মামুনুর রশীদের লেখা দুটি ধারাবাহিক নাটক সে সময় বেশ আলোচিত হয়। একটি নাটকের নাম ‘সময় অসময়’, আরেকটি নাম ‘স্বপ্নের শহর’। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। ‘কোন কাননের ফুল’ নাটকটিও দর্শকদের মাঝে আলোড়ন তুলেছিল। এটি প্রযোজনা করেছিলেন ফখরুল আবেদীন দুলাল। ‘দিনরাত্রির খেলা’, ‘বেলা অবেলা’ সে সময়ের জনপ্রিয় দুটি ধারাবাহিক নাটক। পাশাপাশি জনপ্রিয় সব খণ্ড নাটক তো ছিলই। ঈদ এলে এখনো দর্শক প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ‘জব্বর আলী’ নাটকটি খুঁজে বেড়ায়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, টিভিনাটক এখন অন্তঃসারশূন্য ভিউবাণিজ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল মাত্র হানিফ সংকেতের নাটক এখনো দেশীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনেত্রী লাকী ইনাম বলেন, ‘বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন নাটকে প্রমিত বাংলা ব্যবহার হচ্ছে না। টিভিনাটকে বা অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা রুচিহীন হচ্ছে। যে ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে সেই শুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার কোনো টিভিনাটকে নেই বললেই চলে। নির্দিষ্ট আঞ্চলিক ভাষা ছাড়া অশুদ্ধ বাংলা ভাষার ব্যবহার পরিহার করা জরুরি।’