মঙ্গলবার, ৫ জুলাই, ২০১৬ ০০:০০ টা

ওরা কেন বিপথগামী

কোচিং সেন্টারগুলোতে প্রাথমিক উদ্বুদ্ধকরণ। স্যোশাল মিডিয়া ও মাদকে আসক্তি। পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা। হতাশাবোধ, সুস্থ বিনোদনের অভাব। দেশে রাজনৈতিক আদর্শের অনুপস্থিতি।

মাহমুদ আজহার

ওরা কেন বিপথগামী

রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গিই বয়সে তরুণ। তাদের বয়স ১৭ থেকে ২৫-এর মধ্যে। সবাই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। পড়াশোনা করেছেন দেশি-বিদেশি নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাদের ছিল না কোনো অভাব। শুধু এ পাঁচজনই নয়, দেশে-বিদেশে এখন যারা উগ্রপন্থায় জড়িত হচ্ছে, তাদের বড় অংশই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। প্রচলিত জ্ঞানের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত বিদ্যায়ও তারা পারদর্শী। কিন্তু তারা কেন বিপথগামী হলো— বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্ন রাখা হয় দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানীদের কাছে।

মোটা দাগে বিশ্লেষকরা যে বিষয়টিকে ‘মূল সমস্যা’ বলে চিহ্নিত করছেন, তা হলো পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা। এ ছাড়া কোচিং সেন্টারগুলোতে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধকরণ, অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তি, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, মাদকাসক্তিতে হতাশাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শের অনুপস্থিতি, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সুস্থ বিনোদনের অভাবেও তরুণেরা উগ্রপন্থায় ঝুঁকছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অবাধে মোবাইল ফোন, ফেসবুক, টুইটার বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারকেও দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা।

তা ছাড়া সচ্ছল পরিবারে বাবা-মা চাকরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সন্তানকে সময় দেওয়া কিংবা কোনো কিছু নিয়ে পরামর্শ করার সুযোগ থাকে না। অন্যদিকে সন্তানের একাকিত্ব থেকে হতাশাবোধের জন্ম নেয়। জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধপ্রবণতায়; যে সম্পর্কে পরিবার কিছুই জানে না। মোবাইল ফোন, ফেসবুক, টুইটার বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তরুণেরা কী করছে, তারও খোঁজখবর রাখেন না বাবা-মা। সবকিছু পাওয়ার পরও তাদের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা, হতাশাবোধ কাজ করে। এতে তারা ডিপ্রেশনে ভোগে এবং ক্রমেই তাদের দুর্বল করে ফেলে। তখন তারা উগ্রপন্থায় জড়িয়ে পড়ে। বিপথগামিতা থেকে ফিরিয়ে আনায় করণীয় হিসেবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাবা-মাকে সন্তানদের বেড়ে ওঠা ও তার সঙ্গী-সাথীদের ওপর সচেতনভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। সন্তানকে জবাবদিহিতার সংস্কৃতিও বজায় রাখতে হবে। পারিবারিক নানা বিষয়ে সন্তানের মতামতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতে হবে। সন্তান মাদকাসক্ত হচ্ছে কিনা, কার সঙ্গে চলাফেরা করছে তা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেন সন্তানরা সর্বক্ষণ ব্যস্ত না হয়ে পড়ে তার খেয়াল রাখতে হবে। তা ছাড়া সন্তানটি হঠাৎ একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল কিনা, সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। প্রয়োজনে তাকে কাউন্সেলিং করাতে হবে। জানা যায়, গুলশানে জঙ্গি হামলায় অংশ নেওয়া ছয় যুবকের মধ্যে তিনজন ইসলামের নামে উগ্র মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। রোহান ইমতিয়াজ বাংলাদেশের নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল স্কলাস্টিকায় পড়েছে। স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে সে ভর্তি হয়েছিল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আরেক জঙ্গি মুবাশ্বিরও স্কলাস্টিকা স্কুলের ছাত্র ছিল। এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে নিবরাস ইসলামও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। পরে আরও উন্নত শিক্ষার জন্য সে মালয়েশিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। কিন্তু অজ্ঞাত সম্মোহনী শক্তির হাতছানিতে তারা সবাই জীবনের মায়া ত্যাগ করে জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। অথচ কয়েক মাস আগেও এদের কাউকে কাউকে বন্ধুবান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা, কিংবা দেশি-বিদেশি নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে নাচানাচি করতে দেখা গেছে। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে তাদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা যায়। জঙ্গি মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়ে তারা। পারিবারিক সম্পর্কও ছিন্ন করে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মনোবিদ অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল বলেন, গুলশানে জঙ্গি হামলায় অংশ নেওয়া তরুণদের মোটিভ কী আমরা জানি না। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, সন্তানরা যদি পারিবারিক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাহলে বিচ্ছিন্নতা, নিরাপত্তাহীনতা বা বিপথগামী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তখন তারা অপরাধপ্রবণতায় জড়িয়ে পড়ে। এ সুযোগ কাজে লাগায় একটি প্রভাবশালী মহল। তখন ওই তরুণেরা না বলতে পারে না। ধর্ম রক্ষা হচ্ছে, না ধর্মের ক্ষতি হচ্ছে— তা তারা বুঝতে পারে না। এসব তরুণ যখন না চাইতেই সবকিছু পেয়ে যায়, তখন নতুন কিছু পাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে রোমাঞ্চ জাগে। মাদকের মতো তারা ওই পন্থাকে বেছে নেয়। এ নিয়ে উল্লাসও করে। তাই বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের খোঁজ খবর নেওয়া। তাদের সময় দেওয়া। সবকিছু শেয়ার করা। অন্যথায় সন্তানরা এসব মায়াজালে জড়িয়ে পড়তে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আল-কায়েদা বা আইএসের সাইটে যেসব তরুণকে দেখা যায়, তারা সবাই উচ্চ মেধাসম্পন্ন। বাংলাদেশের অনেক বিত্তশালী পরিবারের সন্তানরাও সে পথে চলে গেছে। যা আমাদের বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। ছেলেগুলো কেন যাচ্ছে? আমার মতে, তাদের বাবা-মা সবাই চাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত। সবাই টাকার পেছনে ছুটছেন। তাদের সন্তানদের প্রতি নজর দেওয়া বা দেখভাল করার সময় নেই। সন্তানেরা বেড়ে উঠছে একাকী। তারা কার সঙ্গে মেলামেশা করছে, স্কুলে কার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে তা পরিবার জানে না। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে যে পারিবারিক বন্ধন ছিল, তাও এখন অনুপস্থিত।

সাবেক এই নির্বাচন কমিশনারের মতে, ‘ধনাঢ্য অনেক পরিবারেই এখন ভাঙনের সৃষ্টি হচ্ছে। দরজা বন্ধ করে ছেলেমেয়েরা মোবাইল, ফেসবুক, টুইটারে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী করে— বাবা-মা সেই খেয়ালও রাখেন না। এতে তাদের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা ও হতাশাবোধ কাজ করে। এটা এক পর্যায়ে ডিপ্রেশনে চলে যায়। সেই ডিপ্রেশন তাকে দুর্বল করে ফেলে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ড. জিনাত হুদা বলেন, ‘সমাজটা এখন হয়ে উঠেছে পুঁজিবাদী। সবাই নিজেদের ভোগ নিয়ে ব্যস্ত। এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, খাও দাও ফুর্তি কর। আসলে এসব কারণে পরিবারেও অশান্তি লেগেই আছে। ’৯০-এর আগে পরিবার ও সমাজে যে বন্ধন দেখা যেত তা আর এখন নেই। ওই যে বললাম সবাই এখন পুঁজিবাদী। এসব সমস্যা উত্তরণে পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তাদের ন্যায্য মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, ‘আগে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ত। তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার পেছনে দরিদ্রতা একটা অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা জঙ্গিবাদ বা উগ্রপন্থায় ঝুঁকছে। এর কারণ হলো— পারিবারিক বন্ধন না থাকা। মা-বাবার ব্যস্ততার কারণে ছেলের সঙ্গে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ নেই। বয়সে তারা তরুণ। এ বয়সে ব্রেন ওয়াশের সুযোগ থাকে। তাই একটি গোষ্ঠী তাদের আবেগটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। আরেকটি বিষয় হলো, উচ্চবিত্ত তরুণেরা এ বয়সেই যা পায়, তা অনেকেই পায় না। সবকিছু হাতের নাগালে পাওয়ার সুখটাও একটা বড় সমস্যা। জঙ্গি বা উগ্রবাদী পথে যারা যাচ্ছে, তারা প্রযুক্তিগত বা মেধা-মননে অনেক এগিয়ে। তরুণেরা এটাতেও উদ্বুদ্ধ হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক তরুণ দেশ ছেড়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। এভাবে যারা নিখোঁজ হয়েছেন তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। এরপর তালিকা ধরে ধরে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে হবে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নজরদারি বাড়াতে হবে। তাহলেই জঙ্গিবাদের এই বিষবাষ্প থেকে রক্ষা পাবে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র।’ ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন আরও বলেন, ‘একজন তরুণ যখন দেখে তুরস্কের সাগরে ছোট্ট শিশু আয়লান কুর্দি ভাসছে, সিরিয়া, ইরাক জ্বলছে, তখন তার মধ্যে একটা হতাশাবোধ ও অস্থিরতা কাজ করে। তার পরও সে একাকী থাকছে। এ নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে শেয়ারও করতে পারে না। তখন বন্ধুবান্ধব বা কোনো পক্ষ এ নিয়ে কথা বললে, ওই ইভেন্টগুলোর সঙ্গে সে একাত্ম হয়ে যায়। তা ছাড়া ছোট বয়সে সে যখন দেখে, তার স্কুলে ভর্তি হতে হলেও অতিরিক্ত টাকা লাগে। ঘুষ আর দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে সমাজ, তখন সে ডিপ্রেশনে ভোগে। তখন সে মনে করে, এই পৃথিবীতে তারও কিছু করার আছে। তখন সে বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে ওইসব লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তারা নানাভাবে এদের মগজ ধোলাই করে। তরুণদের বলা হয়, এই সমাজ পরিবর্তন করতে হবে। এটা করতে হবে। তখন তাই করে এসব তরুণ। দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যায়।’ তিনি বলেন, ‘ওইসব বিপথগামী তরুণের বাবা-মায়েরাও কিন্তু ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টি নেয়নি। এও একটা সমস্যা। ওই সময় যদি সন্তানদের খুঁজে বের করা যেত, তাহলে এত বড় সমস্যা নাও হতে পারত।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর