বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। প্রয়োজন অনুসারে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কমছে জনশক্তি রপ্তানি। এ পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার বিষয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কেননা টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিও মন্দার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। যার প্রভাব থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও। এ দেশের অর্থনীতির মূল সূচকগুলোতেও দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি। এতদিন রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি আয় ইতিবাচক থাকলেও এখন তা ধরে রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকঢোল পেটালেও কার্যকর তেমন কোনো ফল পাওয়া যায়নি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষ কর্মী গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে সরকার ও বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এজন্য গাজীপুরে আন্তর্জাতিক মানের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করতে যাচ্ছে বায়রা। আগামী পাঁচ বছরে সাড়ে ৩ লাখ বিদেশি দক্ষ কর্মী নেবে জাপান। যা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সুযোগ বলে মনে করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোতেও দক্ষ কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ৩৪ হাজার কর্মী কম গেছেন বিদেশে। অর্থাৎ ২০১৮ সালে ৭ লাখ ৩৪ হাজার ১৮১ জন কর্মী বিদেশে গেলেও ২০১৯ সালে গেছেন ৭ লাখ ১৫৯ জন কর্মী। সে হিসাবে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ৩৪ হাজার ২২ জন কম কর্মী বিদেশে গেছেন। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী ফেরতও আসছেন বিদেশ থেকে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৬৫ হাজার ৩৭২ জন কর্মী ফেরত এসেছেন। আর ২০১৮ সালে ফেরত এসেছেন ৬৮ হাজার ৩৮২ জন কর্মী। শুধু মালয়েশিয়া থেকেই ফেরত এসেছেন ৫০ হাজার কর্মী। এর প্রধান কারণ দেখানো হয়েছে, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া এবং চাকরি হারানো। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো নানা কারণে কর্মীদের ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি না করায় বাধ্য হয়ে তাদের ফেরত আসতে হচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ গত ছয় বছরে সবচেয়ে বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন ২০১৭ সালে। সে বছর বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী। আর সবচেয়ে কম গেছেন ২০১৪ সালে, ৪ লাখ ২৫ হাজার ৬৮৪ জন। অবশ্য সে বছর ফেরতও এসেছেন কম ৪৭ হাজার ২৬১ জন। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্ববাজারে এখন দক্ষ কর্মীর চাহিদা বেশি। ফলে আমরা চেষ্টা করছি প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মীদের দক্ষ করে বিদেশে পাঠানোর। পাশাপাশি মালয়েশিয়া, কুয়েত, সৌদি আরব কিংবা দুবাই অর্থাৎ শুধু মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নয়, বিশ্বের অন্যসব দেশেও কীভাবে দক্ষ কর্মী পাঠানো যায় সে চেষ্টাই আমরা করছি। এজন্য আমরা নতুন নতুন শ্রমবাজার খুঁজছি। যেমন জাপানেও আমরা দক্ষ কর্মী পাঠানো শুরু করেছি এবং দক্ষ কর্মীর একটা প্রভাব কিন্তু পড়তে শুরু করেছে। এজন্য শ্রমিক কম গেলেও রেমিট্যান্স কিন্তু বাড়ছে। সবমিলিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি সামনের দিনগুলোতে আশাব্যঞ্জক হবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় তিনটি শ্রমবাজারের মধ্যে দুটি দীর্ঘদিন যাবৎ প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। এর মধ্যে ১৬ মাস ধরে বন্ধ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। আর সাত বছর ধরে কর্মী পাঠানোয় গতি নেই সংযুক্ত আরব আমিরাতে। নতুন করে বড় কোনো শ্রমবাজারেও ঢুকতে পারেনি বাংলাদেশ। তাই ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে বিদেশে কর্মী পাঠানো। আগের বছরের তুলনায় গত বছর প্রায় ৫ শতাংশ কর্মী কম গেছেন বিদেশে। তার আগের বছর কমেছিল ২৭ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, শিগগিরই মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, এ মাসের শেষের দিকে ঢাকায় দুই দেশের যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এরপর সিদ্ধান্ত হতে পারে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য আদৌ খুলবে কিনা। বিএমইটির তথ্যমতে, ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় গেছেন প্রায় ১ লাখ কর্মী। ২০১৮ সালেও দেশটিতে গেছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার কর্মী। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর দেশটিতে গেছেন মাত্র ৫৪৫ জন। একই অবস্থা বিরাজ করছে সৌদি আরবের শ্রমবাজারেও। এমন কি দুবাইয়ের শ্রমবাজারে সৃষ্টি হওয়া অচলাবস্থার অবসান কবে ঘটবে তা বলা মুশকিল। ১৯৭৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরবে গেছেন ৪০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক ২৩ লাখ ৭১ হাজার কর্মী গেছেন আরব আমিরাতে (দুবাই)।
সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, দীর্ঘদিন ধরে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। কার্যত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। কেননা নতুন কয়েকটি শ্রমবাজারের সম্ভাবনা দেখা দিলেও সেখানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারায় বাংলাদেশ এখনো পিছিয়েই রয়েছে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) প্রেসিডেন্ট বেনজির আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি। বিদেশগমেনেচ্ছুদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে গাজীপুরে। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তো কাজ করছেই। আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই মালয়েশিয়া এবং দুবাইয়ের শ্রমবাজারের সংকট কেটে যাবে। তিনি জানান আগামী পাঁচ বছরে সাড়ে ৩ লাখ বিদেশি দক্ষ কর্মী নেবে জাপান। যা বাংলাদেশের জন্য একটা বড় সুযোগ।