মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা
যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দর কাজে অনিয়ম

পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে প্রকল্প কেটে তিন ভাগ

শাবান মাহমুদ ও মির্জা মেহেদী তমাল

পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে প্রকল্প কেটে তিন ভাগ

যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজে নজিরবিহীন দুর্নীতি আর অনিয়ম ধরা পড়েছে। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে প্রকল্প কেটে তিন ভাগ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিলেও দুটি বিমানবন্দরের প্রকল্পের কাজ করছে অন্য একটি প্রতিষ্ঠান। এ অবস্থায় মুখ থুবড়ে পড়েছে যশোর ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উন্নয়নযজ্ঞ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রকৌশল বিভাগের চরম স্বেচ্ছাচারিতায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ কাজ এখন হুমকির মুখে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। সম্প্রতি কক্সবাজার বিমানবন্দরের প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা দরকার ছিল। অন্য প্রকল্পগুলোতেও কাজের মান নিশ্চিত করতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ খুবই স্পর্শকাতর। এতে গাফিলতি হলে তা আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীসহ ৬ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী ২০ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি এই ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুদক। যোগাযোগ করা হলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহিবুল হক জানান, সব প্রকল্পের বিষয়েই তদন্ত করা হয়েছে। অনেক দুর্নীতি-অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করেন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব। তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বেবিচককে নির্দেশ দেওয়া হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে বেবিচক বিভাগীয় মামলা করে। পরে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ধরনের প্রক্রিয়া চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবন নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ৫০ কোটি ৫১ লাখ টাকা। উল্লেখ করা যেতে পারে, কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ৫০ কোটি বা তারও বেশি হলে টেন্ডারসহ প্রকল্পের আনুষঙ্গিক কাজের দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। সে হিসাবে সৈয়দপুর প্রকল্পের কাজটিও মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারেই থাকার কথা। কিন্তু বেবিচকের এখতিয়ারে রাখার জন্য সুকৌশলে কাজটি তিনটি ভাগে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করে। এর মধ্যে যাত্রী লাউঞ্জ এপ্রোন এলাকা সম্প্রসারণের কাজের মূল্য ২১ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যাত্রী টার্মিনাল ভবন সম্প্রসারণে ২১ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং অপর সম্প্রসারণ ভবনে অপর কাজটির মূল্য ৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। দরপত্রের মাধ্যমে এ তিনটি কাজ পায় যথাক্রমে ২৭১ নম্বর ইব্রাহীমপুর বাজার রোডের মেসার্স ন্যাশনাল ট্রেডার্স, ৮৯ (পুরাতন) ১০৫ (নতুন) নম্বর কাওলা দক্ষিণখানের মেসার্স এমএসসিএল-এমসি জেভি এবং অপর কাজটি পায় ৪৯ নম্বর কাকরাইল, ঢাকার মেসার্স মাজিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। সূত্র জানায়, একই কান্ড ঘটে যশোর বিমানবন্দরের কর্মযজ্ঞে। ৪৭ বছর পর আধুনিকায়নে হাত দেওয়া হয় যশোর বিমানবন্দরে। বিমানের উড্ডয়ন, ল্যান্ডিং ও পার্কিং এরিয়া বৃদ্ধিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে তাই উন্নয়ন কাজের ওয়ার্ক অর্ডার হয় ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট। কর্তৃপক্ষ বলেছেন, পরিকল্পনাধীন ও চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কেটে যাবে এ বিমানবন্দরের সব সংকট। যশোর হবে দেশের আধুনিক বিমানবন্দরের একটি। অথচ সৈয়দপুরের মতো যশোর বিমানবন্দরেও একই কান্ড ঘটানো হয়। এ বিমানবন্দরের নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজের প্রাক্কলিত মূল্য ৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এই কাজটিও তিন ভাগে ভাগ করে টেন্ডার আহ্বান করে বেবিচক। দুটি কাজ পায় ৮৯ (পুরাতন) ১০৫ (নতুন) নম্বর কাওলা দক্ষিণখানের মেসার্স এমএসসিএল-এমসি জেভি এবং ৪৯ নম্বর কাকরাইল, ঢাকার মেসার্স মাজিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এই দুটি প্রতিষ্ঠানও কাজ করছে সৈয়দপুরে। যশোরের অপর কাজটি পেয়েছে দক্ষিণখানের আদনান এন্টারপ্রাইজ। অনুসন্ধানে জানা যায়, বেবিচকের প্রকৌশল বিভাগ একটি বড় কাজকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে এলটিএম-এর মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়। আর ওই ঠিকাদার কাজ না করে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। সূত্র জানায়, কাগজে-কলমে মোট চারটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হলেও এদের কেউই কাজ করছে না। বিমানবন্দরের দুই প্রকল্পের ৬টি কাজই করছে আদীবা ট্রেডার্স নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠান। সূত্র জানায়, আদীবা ট্রেডার্সকে অনৈতিক সুবিধা দিতেই বেবিচকের শীর্ষ প্রকৌশলী সুকৌশলে প্রকল্পগুলো ভাগ করে ছোট করে টেন্ডার আহ্বান করেছেন। এসব কাজে যেন কোনো পিডি নিয়োগ দেওয়া না হয় এবং পছন্দের লোকজনই যেন কাজগুলো পায়, এ কারণেই বেবিচকের এখতিয়ারে রাখা হয় প্রকল্প দুটি। বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি ফোনের লাইন কেটে দিয়ে টেক্সট করতে বলেন। টেক্সট করা হলেও তার কোনো রেসপন্স পাওয়া যায়নি। এদিকে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামীসহ ৬ প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী ২০ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি হাজির হতে এই ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুদক। গত মঙ্গলবার দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো নোটিসে তাদের আগামী ২০ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি হাজির হতে বলা হয়েছে। জানা যায়, সিভিল এভিয়েশনের মেইনটেনেন্স, কনস্ট্রাকশন, কেনাকাটা ও ফান্ড ম্যানেজমেন্টে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের শত শত কোটি টাকার অনিয়ম, দুর্নীতি, আত্মসাৎ ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বেবিচকে কী কী প্রকল্পের কাজ হয়েছে তার তালিকা, এ দুই অর্থবছরে কেনাকাটা খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ, একই সময়ে নির্মাণ ও সংস্কার খাতে কত ব্যয় হয়েছে তার বিবরণ, আইটি খাতে কত বরাদ্দ ছিল এবং কী কী কাজ করা হয়েছে তার বিবরণ এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সব ধরনের নিরীক্ষা প্রতিবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করার কথা রয়েছে। বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী সুধেন্দু বিকাশ গোস্বামী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম মাকসুদুল ইসলাম ও নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলামকে ২০ ফেব্রুয়ারি এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুজ্জামান, মো. মোকাব্বর আলী ও উপসহকারী প্রকৌশলী কাজী বায়েজিদ আহমেদকে ২৩ ফেব্রুয়ারি তলব করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর