দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল এ ভাইরাসের সংক্রমণে আরও দুজন মারা গেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন আরও নয়জন। প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার ২৮তম দিনে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০-এ। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন আটজন। দ্রুত রোগী শনাক্তে দেশের ১৪টি স্থানে একযোগে চলছে করোনা শনাক্তকরণ টেস্ট।
করোনাভাইরাস আক্রান্ত ও মৃত ব্যক্তির বাড়ি ও আশপাশের বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে একজন চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সিভিল সার্জন। লক্ষ্মীপুরে নয় পরিবারকে লকডাউন করা হয়েছে। টেকনাফে ১৫টি বাড়ি, চট্টগ্রাম শহরে ছয়টি বাড়ি ও সাতকানিয়ায় চারটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার হবিবুল্লাপুর গ্রামে একজন ভাইরাস পজিটিভ হওয়ায় একটি পাড়া, রংপুরে ধাপের হাট এলাকায় আটটি বাড়ি ও দিনাজপুরে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় কয়েকটি বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।
গত ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত তিনজন শনাক্ত হয়। এরপর ১৪ মার্চ দুজন, ১৬ মার্চ তিনজন, ১৭ মার্চ দুজন, ১৮ মার্চ চারজন আক্রান্ত, মৃত একজন, ১৯ মার্চ তিনজন আক্রান্ত, ২০ মার্চ তিনজন, ২১ মার্চ চারজন আক্রান্ত, মৃত একজন, ২২ মার্চ তিনজন, ২৩ মার্চ ছয়জন আক্রান্ত, মৃত একজন, ২৪ মার্চ ছয়জন আক্রান্ত, মৃত একজন, ২৫ মার্চ মৃত একজন, ২৬ মার্চ পাঁচজন আক্রান্ত, ২৭ মার্চ চারজন আক্রান্ত, ৩০ মার্চ একজন আক্রান্ত, ৩১ মার্চ দুজন আক্রান্ত, ১ এপ্রিল আক্রান্ত তিনজন, মৃত একজন, ২ এপ্রিল দুজন আক্রান্ত, ৩ এপ্রিল পাঁচজন আক্রান্ত, গতকাল নয়জন আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন দুজন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ সম্মেলনে দেশে নভেল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সর্বশেষ এ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। দেশে ৮ মার্চ প্রথমবারের মতো নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ার পর এক দিনে নতুন রোগীর এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা। আক্রান্তের মধ্যে আরও চারজন সুস্থ হয়ে ওঠায় এ পর্যন্ত মোট ৩০ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশ থেকে ৫৫৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪৩৪টি পরীক্ষা করা হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা, আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, এমআইএস শাখার পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান। পরীক্ষার বিস্তারিত ফলাফল সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নতুন আক্রান্ত আটজন এবং মৃত দুজনের বিষয়ে তথ্য দেন। তিনি বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এর একজন গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছিলেন।
আরেকজন আগেই শনাক্ত হয়েছিলেন। একজন ঢাকার বাইরে, একজন ঢাকায়। এর মধ্যে একজনের বয়স ৯০ বছর, আরেকজনের ৬৮ বছর। তারা দুজনই অসুস্থ ছিলেন। একজনের হৃদরোগ ছিল, তার হার্ট স্ট্যান্টিং করা ছিল। আরেকজনের এর আগে স্ট্রোক হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘নতুন শনাক্ত নয়জনের মধ্যে আটজন আইইডিসিআর ও একজনের বিষয়ে ঢাকার বাইরের একটি গবেষণাগারের পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে ঢাকার বাইরে যিনি পজিটিভ এসেছেন তার নমুনা আবার আইইডিসিআরে পরীক্ষা করা হবে। তার আগে ওই ব্যক্তি সংক্রমিত হিসেবে চিহ্নিত হবেন এবং সে অনুযায়ী তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হবে।’
আইইডিসিআর পরিচালক বলেন, ‘আক্রান্তদের মধ্যে পাঁচজন আগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন। এ পাঁচজন ইতিমধ্যে সংক্রমিত হয়েছেন এমন ব্যক্তির পরিবারের সদস্য। দুজন বিদেশ থেকে এসেছিলেন। বাকি দুজন কীভাবে আক্রান্ত হয়েছেন সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।’ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, আক্রান্ত নয়জনের মধ্যে দুজন শিশু যাদের বয়স ১০ বছরের নিচে। তিনজনের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, দুজনের বয়স ৫০ থেকে ৬০, একজনের বয়স ৬০-৭০ এবং একজনের বয়স ৯০ বছর। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও চারজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বলে জানান অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। এ নিয়ে সুস্থ রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৩০-এ। বাকি ৩২ জনের মধ্যে ১২ জন বাড়িতে ও ২০ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ সংবাদ সম্মেলনে জানান, এখন পর্যন্ত ৬৪ হাজার ৬৯৩ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে এবং ২৬০ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৬৯ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইন ও ১২ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে গেছেন ১৮ জন। ছাড়পত্র পেয়েছে বাড়ি ফিরেছেন ২৩ জন। বর্তমানে ৭২ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার একটি বহুতল ভবনে বসবাসরত একজন ডাক্তার করোনা আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন মুহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমি শুনেছি নারায়ণগঞ্জের একজন চিকিৎসক রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।’ নারায়ণগঞ্জ শহরের আমলাপাড়া ও গলাচিপা এলাকার দুটি বাড়িতে সতর্কাবস্থা জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে আমলাপাড়ার এক ব্যক্তি রাজধানীর কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর পরই ওই বাড়িতে সতর্কাবস্থা জারি করা হয়। অন্যদিকে শহরের গলাচিপা এলাকার একটি বাড়িতেও সতর্কাবস্থা জারি করা হয়েছে। ওই বাড়িতে তিনজন রয়েছেন যারা বন্দরে ৩০ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী নারীর স্বজন। এ কারণেই ওই তিনজনের বাড়িতে যান সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের মুন্সিরকান্দি গ্রামে জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় গতকাল আশপাশের পাঁচটি বাড়ি লকডাউন করেছে প্রশাসন। লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার তোরাবগঞ্জ ও চর মার্টিনে দুই শিশু মৃত্যুর পর নয় পরিবারকে লকডাউন করা হয়েছে। টেকনাফে করোনার উপসর্গ থাকায় গতকাল টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য কক্সবাজার মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যদের থেকে নিজ নিজ বাড়িতেই আলাদা করে রাখা হয়েছে। ঢাকায় এক র্যাব সদস্যের কভিড-১৯ পজিটিভ পাওয়ায় টেকনাফে তার শ্বশুরবাড়ি এলাকার ১৫টি বাড়ি ও দোকান লকডাউন করেছে উপজেলা প্রশাসন। চট্টগ্রাম নগরের দামপাড়ায় ৬৩ বছর বয়সী বৃদ্ধের করোনাভাইরাস পজিটিভ হওয়ায় ওই এলাকার ছয়টি বাড়ি লকডাউন করে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই সঙ্গে বৃদ্ধের মেয়ের শ্বশুরবাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার পুরানগড় ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চারটি বাড়ির ১২ পরিবারকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া করোনা আক্রান্ত ওই বৃদ্ধকে দেখতে যাওয়ায় নগরের পাঠানটুলী এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাড়ি ও রোগীর বাড়িতে দাওয়াত খাওয়ায় চন্দনাইশ উপজেলার জামিরজুরী গ্রামে আরেক আত্মীয়ের বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। গাইবান্ধায় করোনায় আক্রান্ত দুই আমেরিকাপ্রবাসীর সংস্পর্শে আসা আরও এক নারীর করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে। এ কারণে জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার হবিবুল্লাপুর গ্রামের পশ্চিমপাড়া লকডাউন করা হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় গতকাল পর্যন্ত পাঁচজন করোনাভাইরাস পজিটিভ রোগী শনাক্ত হলো। রংপুর সদর উপজেলার সদ্যপুষ্করিণী ইউনিয়নের জানকী ধাপের হাট এলাকায় গতকাল আটটি বাড়ি লকডাউন ঘোষণা করেছে সিভিল সার্জন ও স্থানীয় প্রশাসন। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে এনামুল হক সুজা (৫৯) নামে এক ব্যক্তি সর্দি, কাশি, জ্বর নিয়ে মারা গেছেন। ওই বাড়ি ও সামনের রাস্তা লকডাউন করা হয়েছে। করোনার উপসর্গ থাকায় গতকাল কিশোরগঞ্জের তিনজনের শরীরের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় আইইডিসিআরে পাঠানো হয়েছে। তারা বেশ কিছুদিন আগে বিদেশফেরতদের সংস্পর্শে এসেছিলেন। জামালপুরে করোনা আক্রান্ত সন্দেহে শুক্রবার এক স্পিনিং মিল শ্রমিকের নমুনা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। নাটোরে করোনা উপসর্গ নিয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পরীক্ষার জন্য তার নমুনা সংগ্রহ করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। করোনা উপসর্গ নিয়ে রাজশাহী আইডি হাসপাতালে এক নার্স এসেছেন। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। গতকাল তাকে আইডি হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদিকে ভারতে আটকেপড়া বাংলাদেশিদের দেশে ফেরতের অনুমতি দিয়েছে ভারতের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ। এর ফলে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে দুই দফায় বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন ১১৮ বাংলাদেশি। গতকাল ভারতফেরত ৩৮ জনের মধ্যে পাঁচজনের শরীরে উচ্চ তাপমাত্রা পাওয়া গেছে। ঝুঁকিতে থাকা ওই পাঁচজনকে বুরুজবাগান উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আইসোলেশনে রাখার জন্য পাঠানো হয়েছে। নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলায় করোনার লক্ষণ নিয়ে নৃপেন্দ্র দাস নামের এক দিনমজুরের মৃত্যু হয়েছে। তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।