শনিবার, ৬ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য হাহাকার

রোগী হাসপাতালে রেখে সিলিন্ডারের জন্য দৌড়াদৌড়ি, হাসপাতালে নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন, ব্যক্তিপর্যায়ে সিলিন্ডার কেনার হিড়িক, দোকান-অনলাইনে উচ্চমূল্য

জিন্নাতুন নূর

অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য হাহাকার

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের প্রচন্ড সংকট শুরু হয়েছে। দেশের বেশির ভাগ হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম না থাকায় সিলিন্ডারের অক্সিজেন নিয়ে শুরু হয়েছে হাহাকার। তীব্র শ্বাসকষ্টের সময় হাইফ্লো অক্সিজেন দরকার হলেও বেশির ভাগ সময় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোতে তা মিলছে না। অক্সিজেন সংকটের অভিযোগ করেছেন করোনা আক্রান্ত চিকিৎসাধীন রোগীরাও। হাসপাতালে রোগী রেখে স্বজনদের দৌড়াতে হচ্ছে অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য। এর মধ্যেই ব্যক্তিপর্যায়ে সিলিন্ডার কেনার হিড়িক পড়েছে। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কভিড-১৯ না হলেও অনেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাড়িতে মজুদ করছেন। ফলে দোকান-অনলাইনে নেওয়া হচ্ছে উচ্চমূল্য। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অক্সিজেন প্রস্তুতকারী আন্তর্জাতিক কোম্পানি লিন্ডে বলছে, অক্সিজেনের চাহিদা বর্তমানে এতটাই বেড়েছে যে, তারা দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একসঙ্গে একাধিক রোগীর প্রয়োজন হওয়ায় কভিড হাসপাতালগুলোতে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে অক্সিজেন ব্যবহার করতে হচ্ছে রোগীদের। ঈদের আগে এক চিকিৎসক নিজে এবং তার মা-বাবা করোনায় আক্রান্ত হয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল বলেন, প্রথমদিকে চাহিদামতো অক্সিজেন পেলেও ঈদের পরে রোগীর সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঘাটতি দেখা দেয়। তার মতে যদি কোনো হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা না থাকে তবে সেখানে বয়স্ক করোনা আক্রান্ত রোগীদের পক্ষে অক্সিজেন সিলিন্ডার বহন করা সম্ভব না। তিনি আরও জানান, এ ছাড়া ওয়ার্ড বয় ও নার্সরাও সব সময় রোগীর কাছাকাছি থাকেন না। এ সময় অক্সিজেনের প্রয়োজন হলে পাওয়া যায় না। হাসপাতালের এমন করুণ অভিজ্ঞতার কারণে করোনা আক্রান্ত অনেকেই বাড়িতেই চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাদের কেউ কেউ অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাসায় রেখেছেন। এমন এক ক্রেতা ও করোনা আক্রান্ত মিডিয়াকর্মী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, শ্বাসকষ্টের  রোগী হওয়ায় আগাম সতর্কতা হিসেবে তিনি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে বাসায় মজুদ রাখেন। ঘরেই চিকিৎসা নেওয়ায় তিনি বিপদ এড়াতে এমনটি করেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার সংগৃহীত সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, দেশের মাত্র ৫৭টি জেলা হাসপাতালে অক্সিজেন টিউব আছে। আর মাত্র ১০ শতাংশ হাসপাতালে আছে এবিজি (আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইজার)। দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে পালস অক্সিমিটার রয়েছে। সব জেলা হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও মাত্র ১০ শতাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর আছে। দেশের ৫৩ শতাংশ হাসপাতালে নেজাল ক্যানোলা এবং দুই-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে অক্সিজেন মাস্ক রয়েছে। এ ছাড়া দেশের ৫৮টি জেলার মধ্যে ১৬টি জেলা হাসপাতালের কোনো বিভাগে একটিও পালস অক্সিমিটার মেশিন নেই। মাত্র ছয়টি হাসপাতালের বহির্বিভাগে পালস অক্সিমিটার আছে। মাত্র নয়টি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক বিভাগে, পাঁচটি জেলা হাসপাতালের সাধারণ বিভাগে, ৩১টি জেলা হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে, তিনটি জেলা হাসপাতালের আইসিইউতে পালস অক্সিমিটার মেশিন রয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকার পর চিকিৎসায় ব্যবহৃত দরকারি বিভিন্ন সামগ্রী যেমন অক্সিমিটার, পোর্টেবল অক্সিজেন ক্যান, পোর্টেবল ভেন্টিলেটর, ফেস-শিল্ড এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডারের বিক্রি ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। রাজধানীতে অক্সিজেন সিলিন্ডার হোম ডেলিভারির সঙ্গে জড়িত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এপ্রিল মাস থেকে তাদের কাছে সিলিন্ডারের বাড়তি চাহিদা আসতে শুরু করে। আর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ডেলিভারি দিতে গিয়ে তারা রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। বিক্রি হওয়া সিলিন্ডারের মধ্যে চায়না কোম্পানি সিলিন্ডারের চাহিদা বেশি থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান এখন এই সিলিন্ডারটির অর্ডার নেওয়া বন্ধ রেখেছে। করোনা আতঙ্কে এরই মধ্যে অনলাইনে অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনার হিড়িক পড়ে গেছে।

হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে এবং হাসপাতালের চিকিৎসার ওপর ভরসা রাখতে না পেরে বাড়িতে চিকিৎসাধীন করোনা রোগীরা ব্যাপকভাবে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনছেন। আর চাহিদা বেশি থাকায় হোম সার্ভিসে অক্সিজেন ডেলিভারির বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে। তবে অনলাইন ভিত্তিক এসব প্রতিষ্ঠান উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে সিলিন্ডার। আবার বাড়তি মূল্যের কারণে কিনতে না পেরে কেউ কেউ ভাড়ায় নিচ্ছেন অক্সিজেন সিলিন্ডার। অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশাপাশি পোর্টেবল অক্সিজেন ক্যান ও দেহের অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের জন্য পালস অক্সিমিটার নামের ছোট একটি যন্ত্রও অনলাইনে ভালো বিক্রি হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহারে প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনলাইনে হোম ডেলিভারির জন্য সিলিন্ডারপ্রতি দাম রাখা হচ্ছে ২২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৩৮ হাজার টাকা। আবার মাসিক ভাড়ায়ও মিলছে সিলিন্ডার। সেক্ষেত্রে ভাড়া ১১ থেকে ১৫ হাজার টাকা। খালি সিলিন্ডার রিফিলের খরচ এক হাজার থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। শপ বিডি ডটকম, মাইসা অক্সিজেন সিলিন্ডার, ইসরাত অক্সিজেন হোম সার্ভিস, অক্সিজেন সাপ্লাই ও সালাউদ্দিন অক্সিজেন সাপ্লাইসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান অনলাইনে অর্ডার নিচ্ছে। অনলাইনে চায়না ও লিন্ডে কোম্পানির অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করছে মাইসা অক্সিজেন সিলিন্ডার নামের প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তন্বী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, দুই মাস আগেও যেখানে প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়টি সিলিন্ডার বিক্রি হতো এখন ১৫ থেকে ১৬টি বিক্রি হচ্ছে। এমনকি চাহিদা এতই বেড়েছে যে, সিলিন্ডার দিয়ে তারা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি আরও জানান, চাহিদা বেশি থাকায় ঘন ঘন সিলিন্ডারের মূল্য বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আমাদের অফিসে এসে কিনছেন আবার কুরিয়ারে ঢাকার বাইরে থেকেও সিলিন্ডার কিনছেন। জানা যায়, তাদের চায়না কোম্পানির সিলিন্ডারের দাম ২৬ হাজার টাকা আর লিন্ডে কোম্পানির অক্সিজেন সিলিন্ডার ৩৮ হাজার টাকা। এর সঙ্গে পালস অক্সিমিটার কিনলে বাড়তি সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারিভাবে যেসব অক্সিজেন সিলিন্ডার খোলা বাজারে বিক্রি বা ভাড়ায় দেওয়া হচ্ছে তা কোথা থেকে আমদানি করা হচ্ছে এবং এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ কিনা তা যাচাই ছাড়াই বাজারজাত করা দ-নীয় অপরাধ। আর এভাবে ঢালাও অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করা কোনোভাবেই উচিত নয়। তা ছাড়া বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার ফলে অগ্নিকান্ডের মতো বড় ধরনের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসকরা আরও বলেন, দেহে কতটুকু অক্সিজেন দরকার হবে তার জন্য রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। সাধারণত দুভাবে অক্সিজেন দেওয়া হয়- একটি হচ্ছে মাস্কের সাহায্যে। অপরটি ভেন্টিলেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে। দুটি পদ্ধতিতেই চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। কারণ দেহের অক্সিজেন লেভেল পরিমাপের পরই প্রতি মিনিটে কতটুকু অক্সিজেন প্রবাহ প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা হয়। শ্বাসকষ্ট হলেই অক্সিজেন নেওয়ার প্রয়োজন নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর