সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মূর্তিমান আতঙ্ক সাইফুর-রনি

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনার মূলহোতা ছাত্রলীগ ক্যাডার সাইফুর রহমান ও শেখ মাহবুবুর রহমান রনি ক্যাম্পাসে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। শিক্ষক, সাধারণ শিক্ষার্থী, নিজ দলের কর্মী ও কলেজের পাশর্^বর্তী টিলাগড় এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে ত্রাস ছিল তারা। হোস্টেল সুপারের বাংলো দখল করে জুয়ার আসর বসাত তারা। তাদের ইভটিজিং ও নির্যাতনের শিকার হয়ে কলেজ ছেড়েছেন অনেক ছাত্রী। ক্যাম্পাসে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কলেজে বেড়াতে আসা তরুণীদের ধর্ষণ করা ছিল তাদের নৈমিত্তিক কাজ। ক্যাম্পাসে আধিপত্য থাকায় দলের ‘বড় ভাই’দের কাছেও বিশেষ কদর ছিল তাদের। আর নির্যাতনের ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতেন না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনার পর বেরিয়ে আসছে সাইফুর-রনি ও তাদের সহযোগীদের নানা অপকর্মের কাহিনি। সাইফুর ও রনিসহ গণধর্ষণ মামলার সব আসামি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রণজিৎ সরকার গ্রুপের কর্মী। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য নাজমুল ইসলামের নেতৃত্বে তারা কলেজে রাজনীতি করত।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে কারণে প্রতিদিন বিকালে শত শত তরুণ-তরুণী বেড়াতে আসেন ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে। অনেকে ঘোরাঘুরি করে ক্যাম্পাসের নির্জন এলাকায় চলে যান। এ রকম জায়গায় কোনো দম্পতি বা প্রেমিকজুটিকে পেলে সাইফুর ও রনি তাদের সহযোগীদের নিয়ে চড়াও হতো। আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করত তারা। ছিনতাই করতে গিয়ে ছুরিকাঘাতেরও ঘটনা ঘটেছে বহুবার। সন্ধ্যার পর বা রাতে ক্যাম্পাসে প্রেমিকযুগল পেলে আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সাইফুর-রনি চক্র তাদের তুলে নিত পাশর্^বর্তী ছাত্রাবাসে। সেখানে নিয়ে ধর্ষণ করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। আত্মসম্মানের ভয়ে কেউই মুখ খুলতেন না। রাতে টিলাগড়-বালুচর সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী লোকজনকে ছাত্রাবাসে ধরে এনে নির্যাতন ও ছিনতাই করত তারা। এসব অপকর্মে সাইফুর ও রনির সহযোগী ছিল গণধর্ষণ মামলার আসামি ছাত্রলীগের অপর চার ক্যাডার তারেক, রবিউল, মাহফুজ ও অর্জুনসহ আরও কয়েকজন। 

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসকে কেন্দ্র করে সাইফুর ও রনি তাদের টর্চার সেল গড়ে তোলে। হোস্টেল সুপারের বাংলো দখল করে থাকত সাইফুর। ভয়ে অন্যত্র থাকতেন হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন। হোস্টেলের নতুন ভবনের ২০৫ নম্বর কক্ষ ও বাংলোয় সাইফুরের নেতৃত্বে বসানো হয় ‘শিলং তীর জুয়া’র আসর। এ ছাড়া প্রতিদিন রাতে বসত মাদকের আসর। করোনা পরিস্থিতির কারণে হোস্টেল বন্ধ থাকায় নিজের দখলে থাকা হোস্টেলের রুমকে মাদকসেবন ও ইয়াবা ব্যবসার আখড়ায় পরিণত করে সাইফুর। গণধর্ষণের ঘটনার পর শুক্রবার রাতে সাইফুরের দখলে থাকা হোস্টেলের ২০৫ নম্বর রুম থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সাইফুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলাও হয়েছে।

২০১৩ সালে কলেজে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির সময় চাঁদাবাজি শুরু করে সাইফুর ও তার সহযোগীরা। এতে বাধা দেওয়ায় নিজদলের কর্মী ছদরুল ইসলামের বুকে ছুরিকাঘাত করে সাইফুর। গুরুতর আহত ছদরুলকে সিলেট থেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে। পরে গ্রুপের নেতাদের চাপে ছদরুল বাধ্য হয় মামলা আপস করতে। কলেজ সূত্র জানায়, কলেজে মেয়েদের প্রেমের প্রস্তাব দিত শেখ মাহবুবুর রহমান রনি। জোর করে সে ছাত্রীদের মোবাইল নম্বর নিত। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে সে প্রকাশ্যে তাদের লাঞ্ছিত করত। রনির নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক ছাত্রী কলেজ ছেড়ে গেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় প্রায় আড়াই বছর আগে ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ছুরিকাঘাত করে রনি। কিন্তু দলীয় প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যায় সে। গ্রুপের শীর্ষ নেতা আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভেকেট রণজিৎ সরকার ও এমসি কলেজ ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণকর্তা নাজমুল ইসলামের আর্শীবাদ থাকায় ক্যাম্পাসের ভিতর ও বাইরে বেপরোয়া ছিল সাইফুর ও রনি। শাহ রনি ও তার সহযোগী ধর্ষণ মামলার অন্যতম আসামি তারেক নিজেদের র‌্যাব-পুলিশ পরিচয় দিত বলেও অভিযোগ রয়েছে। র‌্যাব ও পুলিশ পরিচয় দিয়ে রাস্তা থেকে লোকজন অপহরণ করে ছাত্রাবাসে নিয়ে মুক্তিপণ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া সাইফুর ও রনি চক্রের হাতে ক্যাম্পাসে একাধিকবার সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর