বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

সমন্বয়হীনতায় সংকট প্রশাসনে

রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, তৈরি হচ্ছে নানামুখী ভুল বোঝাবুঝি বিশেষজ্ঞদের মতে সবার সমন্বিত কর্মে সমস্যার উত্তরণ সম্ভব

নিজস্ব প্রতিবেদক

সমন্বয়হীনতায় সংকট প্রশাসনে

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তিন বিভাগ বিচার, আইন ও নির্বাহী বিভাগ আস্থা ও নির্ভরশীলতা নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে ভুল বোঝাবুঝি বাড়ছে। এতে পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। তিন বিভাগের সমন্বয়হীনতায় সংকটে প্রশাসন। মাঠ প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরকারের উন্নয়ন কাজসহ অন্যান্য কর্মকান্ড। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে ভুল বার্তা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনায় এই তিন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশের একাধিক স্থানে আইন সভার সদস্য থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব দেখা গেছে। একইভাবে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যেও কোথাও কোথাও ভুল বোঝাবুঝি দেখা গেছে। ফলে সরকারের অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সাবেক আমলা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ভুল বোঝাবুঝির অবসানে রাষ্ট্রের তিন বিভাগকে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করা জরুরি। তারা বলছেন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ- নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে অবশ্যই যথাযথ সমন্বয় ও সুসম্পর্ক থাকতে হবে। মানুষ এমন একটি অবস্থান আশা করে যেখানে রাষ্ট্রের এই তিনটি বিভাগ একে অপরের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করবে না। এই বিভাগগুলো সংবিধান এবং তাদের নিজেদের আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। তাহলেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার পাশাপাশি শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটবে না।  মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রত্যেককেই বুঝতে হবে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অঙ্গই প্রয়োজনীয়। এই প্রয়োজনীয়তার প্রতি একে অন্যের সম্মান, আস্থা ও মর্যাদা থাকতে হবে। তাহলে সংকট যেমন তৈরি হবে না, তেমনি কোনো সংকট বা সমস্যা সৃষ্টি হলে তার উত্তরণও ঘটবে। সাবেক মুখ্য সচিব আবদুল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে সমন্বয়টা অত্যন্ত জরুরি। এই তিন বিভাগেরই জানা আছে তাদের নিজেদের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে। তাদের প্রত্যেকের যে সীমারেখা আছে তা মেনে চললেই সব সমস্যার সমাধান হয়। তিনি বলেন, প্রত্যেককেই তাদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করা বন্ধ করতে হবে। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনায় এই তিন বিভাগের প্রত্যেকেই যদি নিজেদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করে তাহলে কোনো সমস্যা যেমন সৃষ্টি হবে না, তেমনি কোনো ভুল বোঝাবুঝি হলে তা থেকে দ্রুত উত্তরণও সম্ভব হবে। 

সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, এই তিন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং সুসম্পর্কের খামতি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের দ্বন্দ্ব বাড়ছে। যার ফলে মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার বিষয়গুলো অহেতুক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

তিনি বলেন, তাই যে কাজটি সর্বাগ্রে করা প্রয়োজন তা হলো, সংবিধান অনুসারে প্রশাসন ও রাজনীতি পৃথককরণ। আইন, বিধিবিধান, রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী প্রশাসনকে চলতে দেওয়া। তিনি এ কথাও বলেন, আমরা জানি, নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় ও সুসম্পর্কের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সংবেদনশীল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সমন্বয় এবং একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্যটির যোগাযোগ থাকতে হবে। দেখা যাচ্ছে, তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে উন্নয়নসহ নানা বিষয় ব্যাহত হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে পরিচালিত হতে হবে। এক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা অন্য প্রতিষ্ঠান প্রভাবিত হলে চলবে না। এক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা অন্য প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হলে চলবে না। আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে, এক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা অন্য প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এটা বন্ধ করতে হবে।

জি এম কাদের বলেন, মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রত্যেকের কার কী কাজ তা ভাগ করা আছে। আমি মনে করি, এটি অনুসরণ করে প্রত্যেকে নিজেদের অবস্থান থেকে সমন্বয় করে কাজ করলে কোনো সমস্যা বা সংকট সৃষ্টি হবে না। যে কোনো সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের বাকি দুই বিভাগের সমন্বয় থাকা ঠিকও না। কারণ বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ আলাদা। তবে মামলা নিষ্পত্তি এবং বিচার বিভাগের উন্নয়নে নির্বাহী বিভাগ অবশ্যই বিচার বিভাগকে সহায়তা করবে। তিনি বলেন, তবে আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। এই দুই বিভাগে সমন্বয়হীনতা দেখা দিলে তা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর