রবিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত অভিনেত্রী কবরী

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত অভিনেত্রী কবরী

রাজধানীর বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ‘মিষ্টি মেয়ে’ খ্যাত কিংবদন্তি নায়িকা সারাহ বেগম কবরী। গতকাল বাদ জোহর তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে কবরস্থান প্রাঙ্গণে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রাখায় তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। কবরীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে শুক্রবার রাত ১২টা ২০ মিনিটে মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কবরী। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। রাতে হাসপাতালটির হিমঘরেই তাঁর লাশ রাখা হয়। সকালে ওই হিমঘর থেকে লাশ নেওয়া হয় মোহাম্মদপুরের আল-মারকাজুলে। সেখানে গোসল সম্পন্নের পর লাশ শেষবারের জন্য নেওয়া হয় গুলশান ২-এর লেক রোডের প্রিয় বাসস্থানে। শেষ বিদায় জানাতে গিয়ে এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর স্বজন, সহকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষীরা। শোকের আবহে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার বাতাস। এরপর জানাজা        ও গার্ড অব অনার দেওয়ার পর বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। জানাজায় অংশ নেন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি সোহানুর রহমান সোহান, পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার, শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর ও সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খানসহ চলচ্চিত্র অঙ্গন, রাজনৈতিক অঙ্গন ও কবরীর পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা।

খুসখুসে কাশি আর জ্বরে ভুগলে তাঁর করোনা পরীক্ষায় ৫ এপ্রিল পজিটিভ ধরা পড়ে। ওই দিন রাতেই তিনি কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর ৭ এপ্রিল অবস্থার অবনতি ঘটলে আইসিইউর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন চিকিৎসকরা। কুর্মিটোলায় আইসিইউ না পেয়ে মহাখালীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার থেকে ১৪ এপ্রিল বুধবার পর্যন্ত তিনি হাসপাতালটির আইসিইউতে ছিলেন। দ্রুত অবস্থার অবনতি হওয়ার পর ১৫ এপ্রিল তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। আর সে অবস্থাতেই শুক্রবার রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১। কবরীর জন্ম ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে। তাঁর শৈশব, কৈশোর ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম মহানগরে। চলচ্চিত্রের সোনালি যুগে ষাট ও সত্তরের দশকের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা কবরীর পারিবারিক নাম মিনা পাল। বাবা কৃষ্ণদাস পাল এবং মা লাবণ্যপ্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে কাজ শুরু করেন। আর ১৯৬৪ সালে ১৪ বছর বয়সে সুভাষ দত্তের ‘সুতরাং’ ছবির মধ্য দিয়ে সিনেমার ঝলমলে ভুবনে তাঁর পথচলা শুরু। চলচ্চিত্রটি তাশখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং ’৬৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কৃত হয়। এরপর উর্দু ভাষার ‘বাহানা’ ও ‘সোয়ে নদিয়া জাগে পানি’তে অভিনয়ের পর ’৬৮ সালে ‘সাত ভাই চম্পা’র সফলতায় সিনেমার ইতিহাসে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ওই বছরই ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রে নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়ে অভিনয় শুরু করেন। ময়নামতি (১৯৬৯), নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯), ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০), দর্পচূর্ণ (১৯৭০), কাচ কাটা হীরে (১৯৭০), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৭১), রংবাজ (১৯৭৩) ইত্যাদি চলচ্চিত্রের ধারাবাহিক সফলতায় দর্শকপ্রিয় জুটির তকমা পায় রাজ্জাক-কবরী জুটি। পরে ফারুকের সঙ্গে ‘সুজন সখী’ (১৯৭৫) ও ‘সারেং বৌ’ (১৯৭৮) ছবির সফলতায় এ দেশের চলচ্চিত্রে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন কবরী। আর সেই থেকেই কবরী-ফারুক জুটি সিনেমার রুপালি পর্দায় একটি অনন্য ও জনপ্রিয় জুটির কাতারে উন্নীত হয়। অভিনয়ে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আজীবন সম্মাননাসহ দুটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও ছয়টি বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন কবরী। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রতিদিন তাঁকে আজীবন সম্মাননা দেয়। ‘লালন ফকির’, চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ১৯৭২ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। এরপর সাহিত্যনির্ভর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর রাজার ঝি চরিত্রে ১৯৭৩ সালে এবং ‘সারেং বৌ’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ১৯৭৮ সালে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। এ ছাড়া ‘সুজন সখী’ (১৯৭৫) ও ‘দুই জীবন’ (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আরও দুটি বাচসাস পুরস্কার অর্জন করেন। তাঁর অভিনীত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও ‘সাত ভাই চম্পা’ চলচ্চিত্র দুটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সেরা ১০ বাংলাদেশি চলচ্চিত্র তালিকায় যথাক্রমে প্রথম ও দশম স্থান লাভ করে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে চলে যান তিনি। এরপর কলকাতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং সাং¯স্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন কবরী। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের টিকিটে ২০০৮ সালে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই ‘স্মৃতিটুকু থাক’। কবরী প্রথম বিয়ে করেন চিত্ত চৌধুরীকে। সে বিয়ের বিচ্ছেদের পর ১৯৭৮ সালে সফিউদ্দীন সরোয়ারকে বিয়ে করেন। ২০০৮ সালে সে বিয়েও ভেঙে যায়। কবরী পাঁচ সন্তানের মা।

শোক : কবরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন, পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল জাহিদ ফারুক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু, তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, যুব ও ক্রিড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম প্রমুখ। অন্যান্যের মধ্যে আরও শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের, মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। গণমাধ্যমে প্রেরিত শোকবার্তায় তাঁরা মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোকবার্তায় তাঁরা জানান, অনবদ্য অভিনয়শৈলীর অধিকারী সারাহ বেগম কবরী ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে সিনেমাপ্রেমী মানুষের কাছে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে তাঁর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি যুগের প্রতিভাবান এ অভিনেত্রী বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন, পাশাপাশি দেশের রাজনীতিতেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর মৃত্যুতে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।

সর্বশেষ খবর