বুধবার, ৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

যেখানে সেখানে মাদকের হাট

অলিগলিতেই মিলছে ইয়াবা হেরোইন ফেনসিডিল, অনলাইনে অর্ডার দিলে পৌঁছে যাচ্ছে বাসায়

সাখাওয়াত কাওসার ও আলী আজম

যেখানে সেখানে মাদকের হাট

করোনার থাবায় পুরো বিশ্ব থমকে গেলেও থেমে নেই মাদকের আগ্রাসন। ক্রমেই যেন ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে মাদক। ঢাকাসহ সারা দেশে মাদকের ব্যবহার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। দেশের পুরো সীমান্ত সিল থাকার পরও ঠিক আগের মতোই দেশে ঢুকছে মাদক। তবে মাদকের সহজলভ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক দেদার ঢুকছে দেশের অভ্যন্তরে।  অলিগলিতেই মিলছে ক্রেজি ড্রাগস ইয়াবা কিংবা হেরোইন-ফেনসিডিল। এমনকি ভার্চুয়াল হাটে অর্ডার দিয়েও মিলছে মাদক। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের খবর হলো, দেশের রুট ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে মাদক। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক মুহাম্মদ আহসানুল জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আমাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছি মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে। আগে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস দিয়ে মাদক পাচার করা হলেও এখন সরকারি ডাকব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে পাচারকারীরা এমন খবর আমাদের কাছে আসছে।  ডিএনসির সদস্যরাও বসে নেই।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, করোনার এই সময়ে মানুষের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। ২ মে রাতে কক্সবাজার টেকনাফের হ্নীলা চৌধুরীপাড়া চিতা-সংলগ্ন এলাকা থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে বিজিবি। ১৮ এপ্রিল রাজধানীর রামপুরা থেকে পিকআপ ভ্যানে করে ৫৫ কেজি গাঁজাসহ দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসব মাদক অল্প সময়ের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে মাদকের রুট প্রতিনিয়ত বদল হচ্ছে। ইয়াবার নতুন রুট এখন উপকূলীয় অঞ্চলের নৌপথ। টেকনাফ থেকে কুয়াকাটা, পাথরঘাটা, পিরোজপুরের তেলিখালী হয়ে মোংলা পোর্টে যায় ইয়াবার বড় বড় চালান। আবার কুয়াকাটা-পাথরঘাটা থেকে বরিশাল হয়ে ঢাকায় আসার আরেকটি রুট আছে। এসব নৌপথের প্রতিটিতেই ইয়াবার চালান খালাস করা হয়। পরে তা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জে যায় নৌপথে। একপর্যায়ে ঢাকা শহরের পাশাপাশি সব বিভাগীয় শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে সারা দেশের আনাচ-কানাচে পৌঁছে যায় ইয়াবা।

জানা গেছে, নিরাপত্তার কথা ভেবে বর্তমানে অনেকে আবার ভার্চুয়াল হাটে অর্ডার করে মাদক সংগ্রহ করছেন। যদিও হোম ডেলিভারিতে দাম একটু বেশি। তবে মাঝেমধ্যেই গ্রাহকসহ বিক্রেতার ঠাঁই হচ্ছে কারাগারে। ২৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিসের সামনে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে রাইড শেয়ার পাঠাওয়ের মাধ্যমে মাদক বেচাকেনার সময় শীর্ষস্থানীয় মাদক কারবারি রেজাউল করিম প্রকাশ ‘ডাইল করিম’কে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে ১ হাজার পিস ইয়াবা এবং তিন বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক উদ্ধার হয় মাত্র ১০ শতাংশ। দেশে প্রতিবছর মাদকের জন্য কমপক্ষে ব্যয় হয় ১০ হাজার কোটি টাকা। আর মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। তবে মাদকের সহজলভ্যের কারণে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। নেশার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে। আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুন, ছিনতাই, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিংয়ের মতো অপরাধ। পুলিশ বলছে, যারা ধরা পড়ছে তারা মূলত মাদক বহনকারী। তবে মূল ব্যবসায়ীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই মাদক আইন আরও কঠোর করার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।

র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কে এম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী র‌্যাবের প্রতিটি সদস্য এই লকডাউনের মধ্যেও মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। এর মধ্যেও আমাদের অনেক সফলতা এসেছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের ছোবল থেকে বাঁচাতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এর সঙ্গে কোনো আপস নেই।’

সূত্র বলছে, গাড়ির ফুয়েল ট্যাঙ্ক থেকে সবজিভর্তি পিকআপ, কিছুই বাদ দিচ্ছে না মাদক কারবারিরা। চোরাকারবারিরা অভিনব সব কায়দায় ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে মাদক। প্রাইভেট কারের মবিলের চেম্বারে প্লাস্টিকের প্যাকেটে পুরে রাখা হচ্ছে ইয়াবা। সাইলেন্সার কেটে গুঁজে রাখা হচ্ছে গাঁজার প্যাকেট। কাঁচামালের সঙ্গেও ইদানীং ঢাকায় আসছে মাদকের চালান। কাভার্ড ভ্যানের ভিতর আলাদা চেম্বারও বানিয়েছে অনেকে, যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় চালকের সামনে থাকা বিশেষ সুইচের মাধ্যমে। প্রতিটি চালান ডেলিভারিতে চালক ও হেলপার ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে পাচ্ছে। মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ছে নারী ও শিশুরাও। করোনার এ সময় ঢাকায় বেড়েছে গাঁজার সরবরাহ। পুলিশ ছাড়াও র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন উদ্ধার করছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক।

পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক হায়দার আলী খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মাদকের সংবাদ পেয়েও পুলিশ নীরব থেকেছে এমন কোনো খবর কি আপনাদের কাছে আছে দেখুন, ‘চলমান মহামারীতেও পুলিশ অপরাধ দমনের পাশাপাশি অনেক সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছে। এই সময়েও মাদক উদ্ধার হচ্ছে। এর পরও কারও কাছে কোনো মাদকের খবর থাকলে তিনি ‘৯৯৯’-এ কল করে খবর দিতে পারেন। এর বাইরেও আরও কয়েকটি অ্যাপস রয়েছে।

তিনি বলেন, দেশের ভিতরে কোনো না কোনোভাবে প্রবেশ করে মাদক বহু হাতে ছড়িয়ে পড়ে। বহু হাতে ছড়িয়ে পড়া মাদক উদ্ধার ও মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া বহু ব্যক্তির সন্ধান করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তখন পুলিশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।

নিরাপদ বাহন কুরিয়ার সার্ভিস : ৩০ এপ্রিল বরিশাল নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাংলাবাজার-সংলগ্ন একটি কুরিয়ার সার্ভিসের সামনে থেকে শিশুদের একটি খেলনা সাইকেল থেকে ৩ হাজার ৮৫০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ বলছে, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের খেলনার ভিতরে ইয়াবা দিয়ে তা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাচার করে আসছিল। ২৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়িতে এস এ পরিবহন কুরিয়ারে ইয়াবা বুকিং দিতে এলে ২৮৯ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৯ এপ্রিল কক্সবাজারের চকরিয়ায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস থেকে ইয়াবাসহ একজনকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে ৬ হাজার ৮১৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলছে, তিনি বৈদ্যুতিক বাল্বের প্যাকেটে ইয়াবা পাচার করছিলেন। তবে গত ৩ মে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পোস্ট অফিসে নিউইয়র্কে পাঠানোর সময় ১ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে এপ্রিলে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে জ্যামাইকা পাঠানোর সময় ৭০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উদ্ধার করা মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে- ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ১৭ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৭১.৬ কেজি আফিম, ২১০.৪৪ কেজি হেরোইন, ৩.৮৯৩ কেজি কোকেন, ১০ লাখ ৭ হাজার ৯৭৭ বোতল ফেনসিডিল, ১২৯ লিটার ফেনসিডিল, ৫০ হাজার ৭৯ কেজি গাঁজা, ২ হাজার ৩২৭টি গাঁজার গাছ, ১ লাখ ২৪ হাজার ৬০৮টি অ্যাম্পুল ইনজেকশন। ২০২০ সালে মাদক মামলা হয়েছে ৮৫ হাজার ৭১৮টি এবং আসামি গ্রেফতার হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৪৩ জন।

বিজিবি সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে ৭৩৭ কোটি ৯৩ লাখ ৬৯ হাজার টাকার চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। জব্দকৃত মাদকের মধ্যে রয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৯ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৯ বোতল ফেনসিডিল, ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৯৯ বোতল বিদেশি মদ, ৬ হাজার ৩৩৯ লিটার বাংলা মদ, ১০ হাজার ৪১৬ ক্যান বিয়ার, ১৩ হাজার ৮৫৭ কেজি গাঁজা, ২২ কেজি ১৭ গ্রাম হেরোইন, ৪৬ হাজার ৬২১টি উত্তেজক ইনজেকশন, ৬৪ হাজার ১৬৯টি এনেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট এবং ৩০ লাখ ২৪ হাজার ৯টি অন্যান্য ট্যাবলেট। র‌্যাব সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩ মে থেকে চলতি বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ২ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ৮৫৩ পিস ইয়াবা, ৫ লাখ ২৮ হাজার ৫২১ বোতল ফেনসিডিল, ৪৫ হাজার ১৯৩ কেজি গাঁজা, ২৮ হাজার ৪৪ বোতল বিদেশি মদ, ২৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৩ লিটার দেশি মদ এবং ১৭৭ কেজি হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে। আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৩ হাজার ৯৩৮ জন।

সর্বশেষ খবর