বুধবার, ১২ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ঈদুল ফিতর ইতিহাস করণীয় ও বর্জনীয়

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

ঈদুল ফিতর ইতিহাস করণীয় ও বর্জনীয়

উল্লিখিত শিরোনামে কয়েকটি বিষয় রয়েছে- ১. ঈদ কাকে বলে ২. ফিতর অর্থ কী ৩. সংক্ষিপ্ত ইতিহাস-ঐতিহ্য ৪. এই দিনের করণীয় ও বর্জনীয় কাজ। চলুন একে একে প্রতিটি সংক্ষেপে আলোকপাত করা যাক। ঈদ : ঈদ শব্দটি আরবি ‘আওদুন’ মূলধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ ফিরে আসা, বারবার আসা। পরিভাষায় ঈদ বলতে আমরা উৎসব, পর্ব, আনন্দ ইত্যাদি বুঝি। ফিতর : ফিতর অর্থ ফাটল, ভাঙন, ভাঙা ইত্যাদি।

এক কথায় ঈদুল ফিতর অর্থ হলো রোজা না রাখা বা রোজা ভাঙার পর্ব বা উৎসব। অর্থাৎ সুদীর্ঘ এক মাস সিয়াম-সাধনার পর আল্লাহর নির্দেশে আমরা এ দিন রোজা ভাঙি তাই এ দিনটির নাম ঈদুল ফিতর। এ নাম রাখার কারণ : যেহেতু ঈদুল ফিতর প্রতি বছরই যথাসময়ে আমাদের মাঝে ঘুরেফিরে আসে এবং এ দিনটিতে আমরা একটি মাস সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও ইন্দ্রিয়সম্ভোগে লিপ্ত না হওয়ার যে বিধান ছিল তা ভঙ্গ করি বলে এ দিনটিকে ঈদুল ফিতর নামকরণ হয়েছে। রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিন সম্পর্কে বলেছেন, ‘এ দিনটিতে তোমরা রোজা রেখ না। এ দিন তোমাদের জন্য আনন্দ-উৎসবের। খাওয়া, পান করা আর পরিবার-পরিজনের সঙ্গে আনন্দ-উৎসব করার দিন। আল্লাহকে স্মরণ করার দিন।’ [মুসনাদ আহমাদ, ইবনে হিব্বান]।

ইতিহাস-ঐতিহ্য : রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় গেলেন। তিনি সেখানে এসে অন্য রকম পরিবেশ পেলেন। তিনি দেখলেন মদিনাবাসী পারসিকদের শিক্ষা ও কালচারে প্রভাবিত হয়ে বসন্তের পূর্ণিমা রজনীতে ‘মেহেরজান’ আর হেমন্তের পূর্ণিমা রজনীতে ‘নওরোজ’ নামক উৎসবে এমন সব আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠত যা কোনো সুস্থ বিবেকবান লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই তিনি মদিনাবাসীকে ডেকে বললেন, এ বিশেষ দিনে তোমাদের আনন্দ-উল্লাসের কারণ কী? মদিনার নওমুসলিমরা তাঁকে বললেন, ‘আমরা জাহেলি যুগ থেকে এ দুটি দিন এভাবেই পালন করে আসছি।’ মহানবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ এ দুটি দিনের পরিবর্তে অন্য দুটি দিন তোমাদের আনন্দ-উৎসব পালনের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হলো ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা। তোমরা পবিত্রতার সঙ্গে এ দুটি ঈদ বা উৎসব পালন করবে।’ [আবু দাউদ ও নাসায়ি]। ঈদুল ফিতরের নামাজ সম্পর্কে আল কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিশ্চয় সে ব্যক্তি সাফল্য অর্জন করেছে যে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করেছে এবং তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করেছে। এরপর নামাজ আদায় করেছে।’ [সুরা আলা, আয়াত ১৪-১৫]। মুফাসসিররা উল্লিখিত আয়াতের অনেক ব্যাখ্যা করেছেন, তবে ‘আহকামুল কুরআন’ নামক কিতাবে বলা হয়েছে, ‘এখানে নামাজ আদায় করা দ্বারা ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের কথা বলা হয়েছে।’ এ আয়াত থেকে আমরা ঈদুল ফিতরের প্রমাণ পাই। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আপনি আপনার প্রভুর উদ্দেশে সালাত আদায় করুন এবং কোরবানি করুন।’ [সুরা কাওসার, আয়াত ২]। হজরত হাসান বসরি (রহ.) বলেন, এ আয়াতটিতে ঈদুল আজহার নামাজ ও কোরবানির নির্দেশ দান করা হয়েছে। এ আয়াত থেকে আমরা ঈদুল আজহার বিষয়টি পরিষ্কার বুঝতে পারি। সেই তখন থেকে মুসলিম উম্মাহ যথারীতি প্রতি বছর ঈদুল ফিতর পালন করে আসছে। এ হিসেবে এ বছরও মহান রব্বুল আলামিনের ইচ্ছায় সব মুসলিম ঈদুল ফিতর আদায় করবে। তবে এ ঈদ, আনন্দ-উৎসব পালন করতে হবে ইসলামী শরিয়তের দিকনির্দেশ অনুযায়ী। খেয়াল রাখতে হবে মুসলমানের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি। সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়িন, তাবেতাবেয়িন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদরা কীভাবে ঈদ পালন করেছেন। আমরাও তাদের মতো ঈদ, আনন্দ-উৎসব পালন করব ইনশা আল্লাহ। করণীয় ও বর্জনীয় কাজ : ঈদের দিন করণীয় ও বর্জনীয় কাজ : ১. রোজা না রাখা : ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম। এ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু সাইদ খুদরি (রা). থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই ঈদের দিন (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।’ [বুখারি]। ২. গোসল করা : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা). থেকে বর্ণিত, ‘রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে গোসল করতেন।’ [মুয়াত্তা ইমাম মালিক]। ৩. কিছু খাওয়া : রোজার ঈদে নামাজ পড়ার জন্য যাওয়ার আগে কিছু আহার করার কথা হাদিসে আছে। বিশেষ করে হাদিসে খেজুর বা মিষ্টি জাতীয় জিনিস খাওয়ার কথা উল্লেখ আছে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেজুর না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না।’ [বুখারি]। ৪. আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা : ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, ‘প্রতি ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার করা ও সুসজ্জিত হওয়া মুস্তাহাব।’ [আল মুগনি]। ৫. সুন্দর পোশাক পরিধান করা : ঈদের আরেকটি করণীয় হলো এ দিনটিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর পোশাক পরিধান করা। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি সুন্দর জুব্বা ছিল যা তিনি দুই ঈদে ও জুমার দিন পরতেন।’ [বায়হাকি]। ৬. সাদাকাতুল ফিতর আদায় : হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘শরিয়তে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করাকে ওয়াজিব করা হয়েছে; যা একদিকে ত্রুটিযুক্ত রোজাকে পবিত্র করে, অন্যদিকে এর দ্বারা অসহায়-নিঃস্বদের প্রয়োজন কিছুটা হলেও পূরণ হয়।’ ৭. হেঁটে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাওয়া এবং এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসা : সাইদ ইবনে জুবাইর ঁরা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক রাস্তা দিয়ে ঈদের নামাজে যেতেন এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসতেন।’ [বুখারি]। ৮. তাকবির বলা : তাকবির বলতে বলতে ঈদের নামাজ পড়ার জন্য যাওয়া। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত আছে, রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাকবির বলতেন। তাকবির বলতে হবে এভাবে : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। ৯. ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় : ঈদের দিন পারস্পরিক ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করা। এভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় করা ‘তাকাব্বালুল্লাহা মিন্না ওয়া মিনকুম’ (আল্লাহ আমাকে ও আপনাকে কবুল করুন) ইত্যাদি। ১০. ঈদের নামাজ আদায় : ঈদের দিন ঈদের নামাজের আগে অন্য কোনো নামাজ আদায় করা ঠিক নয়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিন বের হয়ে শুধু ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। ঈদের নামাজের আগে বা পরে (সঙ্গে সঙ্গে) নফল বা অতিরিক্ত কোনো নামাজ আদায় করতেন না।’ [বুখারি, মুসলিম ও তিরমিজি]। ১১. খুতবা শোনা ও দোয়া করা : ঈদের নামাজের পর ইমাম খুতবা প্রদান করবেন এবং মুসল্লিরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। এটি পালন করা ওয়াজিব। ইত্যাদি।

তাই চলুন আমরা সবাই মিলে সুন্দর একটি ঈদ উদ্যাপন করি, যেখানে ধনী-গরিবের শ্রেণিভেদ থাকবে না। সবাই মিলে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করে বলব, ‘আলহামদু লিল্লাহি আলা কুল্লি হাল’ (সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রশংসা)। এভাবে ঈদ পালন করার মাধ্যমে আমাদের মাঝে জান্নাতি একটা পরিবেশ বিরাজ করবে ইনশা আল্লাহ। তবে সবাই বর্তমান করোনা অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখব। যাতে কোনোভাবেই স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার যে নিয়মপদ্ধতি দেওয়া আছে তা লঙ্ঘিত না হয়। মহান রবের কাছে সুন্দরতম একটি ঈদ কামনা করছি।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির, খতিব ও টিভির ইসলামী প্রোগ্রাম উপস্থাপক।

সর্বশেষ খবর