বৃহস্পতিবার, ১৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

দেশেই হোক টিকা উৎপাদন

চীন থেকে আরও দেড় কোটি টিকা কেনার অনুমতি । অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২৯ লাখ দিচ্ছে জাপান । আগের চেয়ে কম দামে দিচ্ছে চীন : অর্থমন্ত্রী । প্রযুক্তি দিতে চায় না চীন-রাশিয়া । দ্রুত উৎপাদনের পক্ষে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা

লাকমিনা জেসমিন সোমা ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

দেশেই হোক টিকা উৎপাদন

চীনের সঙ্গে আরও দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে সরকার। এর আগেও চীন থেকে দেড় কোটি টিকা কেনার চুক্তি হয়েছে। তবে কিনে এনে গণটিকাদান কঠিন হওয়ায় দেশে টিকা উৎপাদন ঘিরে চলছে জোর আলোচনা। দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে টিকা উৎপাদনে সক্ষমতা। কিন্তু টিকা বিক্রির চুক্তিতে আগ্রহী হলেও উৎপাদনে প্রযুক্তি দিতে চায় না চীন-রাশিয়া।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দুই দেশের সঙ্গেই আমরা যৌথভাবে উৎপাদনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দুই দেশই এ প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো তারা (চীন, রাশিয়ার কোম্পানি) শুধু ফিনিশিং এবং সেটিং অর্থাৎ টিকা বোতলে ভরার চূড়ান্ত কাজটুকু বাংলাদেশে করতে চায়। তাদের প্রযুক্তি দিতে চায় না। আমাদের কোম্পানিগুলো টিকা বানাতে চায়, টিকার প্রযুক্তিও চায়। কিন্তু কোনো দেশই তার প্রযুক্তি দিতে রাজি হচ্ছে না। আর রাষ্ট্র হিসেবে আমরা বলেছি- ইট শুড বি এ পাবলিক গুডস। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনও বলেছেন “দিস টেকনোলোজি শুড বি ওন্্ড বাই অল কান্ট্রিজ”। এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। আমরা বিষয়টি বিশ্বের সব ফোরামে তুলে ধরব।’

যৌথ উৎপাদন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের ডেপুটি চিফ অব মিশন হুয়ালং ইয়ান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের দুটি কোম্পানিই বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। চীন বিশেষ করে সিনোফার্ম বাংলাদেশের ইনসেপ্টার সঙ্গে যৌথ উৎপাদনে যেতে পুরোপুরি প্রস্তুত। আমাদের এখন বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন দরকার।’ যৌথ উৎপাদনে গেলেও চীন টিকা উৎপাদনের মূল প্রযুক্তি দিতে চায় না- বিষয়টির ব্যাখ্যা জানতে চাইলে এই চীনা কূটনীতিক বলেন, ‘এটা দুই দেশের সরকারের দরকষাকষির বিষয় নয়, দুই দেশের সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর বিষয়। সরকার চাইলেই একটি কোম্পানিকে তাদের মেধাস্বত্ব বিনিময় করতে বলতে পারে না। সে কারণে ইনসেপ্টার বরং সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক্সের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।’

পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চীনের সিনোফার্ম ও সিনোভ্যাক দুই প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করতে চায়। এ বিষয়ে তারা বাংলাদেশি তিনটি প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচনও করে ফেলেছে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এখন তারা নানা রকম দরকষাকষি করছে। এর আগে ২২ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই এখন টিকা ব্যবসায়ী। সবাই আমাদের কাছে টিকা বিক্রি করার জন্য আসছে। এখন সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, সাহিত্যিক, গায়ক সবাই টিকা ব্যবসায়ী।’ জানা যায়, চীন-রাশিয়া কেউই তাদের টিকা উৎপাদন প্রযুক্তি দিতে রাজি না হওয়ায় এগোচ্ছে না দেশেই উৎপাদন প্রক্রিয়া। দেশ দুটির সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে রাজি করাতে প্রতিনিয়তই চিঠি চালাচালি করছে পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু উভয় দেশই যৌথ উৎপাদনের চেয়ে উপহারের আড়ালে বাংলাদেশের কাছে টিকা বিক্রিতে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।

তাশখন্দে ভারত, চীন ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বসবেন মোমেন : মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক কানেকটিভিটি-বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে গতকাল উজবেকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা যায়, সম্মেলনের সাইডলাইনে তাশখন্দে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুর পাশাপাশি টিকা সরবরাহ ও উৎপাদন অগ্রগতি বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলে জানা গেছে। চীনের সঙ্গে বৈঠকে নতুন করে আরও ১০ লাখ টিকা উপহারেরও ঘোষণা আসতে পারে। এ ছাড়া দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশে টিকার প্রযুক্তি বিনিময় ও উৎপাদন শুরু করতে অনুরোধ জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রস্তাব অনুমোদন : চীনের সিনোফার্ম থেকে দেড় কোটি করোনা টিকা কেনাসহ ছয়টি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে ‘সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি’। টিকা কেনা ছাড়া চারটি ক্রয় প্রস্তাবে মোট ব্যয় হবে ৭৫১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া দর সংশোধনের একটি প্রস্তাবে ব্যয় কমেছে ৩ কোটি ৬ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

গতকাল সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ক্রয় কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শামসুল আরেফিন এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের জানান, ‘সিনোফার্ম ভ্যাকসিন সাপ্লিমেন্টাল অ্যাগ্রিমেন্ট-১’-এর আওতায় চীনা প্রতিষ্ঠান ‘সিনোফার্ম ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে চুক্তিবদ্ধ ১ কোটি ৫০ লাখের মধ্যে অবশিষ্ট ১ কোটি ৩০ লাখ এবং নতুন প্রস্তাবিত ২০ লাখ- সর্বমোট দেড় কোটি ডোজ টিকা আমদানির একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের আওতায় কেন্দ্রীয় ঔষধাগার এ টিকা আমদানি করবে। ইতিপূর্বে চুক্তিপত্রে উল্লিখিত মূল্যের চেয়ে কম মূল্যে টিকা কেনা হচ্ছে বলে বৈঠকে জানান তিনি। এর আগে ১৯ মে চীনের সিনোফার্ম থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার বিষয়টি অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদিত হয়েছিল। এ চুক্তির আওতায় প্রথম চালান হিসেবে ২০ লাখ ডোজ টিকা দেশে এসেছে। এ নিয়ে চীনের সঙ্গে দুই ধাপে ৩ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করল বাংলাদেশ। এ ছাড়া চীন উপহার হিসেবে দিয়েছে সিনোফার্মের ১১ লাখ ডোজ টিকা। কোভ্যাক্স সহায়তা থেকে বাংলাদেশ ফাইজারের ১ লাখ আর মডার্নার ২৫ লাখ ডোজ টিকা পেয়েছে। এবার কোভ্যাক্সের মাধ্যমে জাপান ২৯ লাখ ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিচ্ছে। এ টিকা হাতে এলে অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রথম ডোজ নিয়ে অপেক্ষমাণ প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে দেওয়া হবে দ্বিতীয় ডোজ টিকা। বাকি টিকা প্রথম ডোজ হিসেবে অন্যদের দেওয়া হবে।

দ্রুত টিকা উৎপাদনের পক্ষে মত বিশেষজ্ঞদের : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম রেজা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ অবশ্যই টিকা উৎপাদনে সক্ষম। টিকা উৎপাদন করা যায় এমন ডেডিকেটেট ইনস্টিটিউড করা যেতে পারে। আমি একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে বলব, বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোরও বিশ্বমানের সুবিধা আছে। সরকার ও ওষুধ কোম্পানিগুলোর সদিচ্ছা থাকলে এটা সম্ভব।’ বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওষুধশিল্পে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। বিশ্বের ১৫১ দেশে বাংলাদেশের কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধ রপ্তানি হয়। ১৭ কোটি জনসংখ্যার প্রয়োজনীয় ৯৯ ভাগ ওষুধই দেশে উৎপাদন হয়। এ ওষুধ বাইরে থেকে আমদানি করলে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে যেত। টিকা কিনতে গিয়ে যেমন খরচ হচ্ছে এবং অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর বেশ কয়েকটির টিকা তৈরির অভিজ্ঞতা আছে। ওষুধশিল্পের বিকাশের পাশাপাশি সরকারের খুব দ্রুত দেশে টিকা উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। আমরা টিকার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ তৈরিতে সক্ষম। অন্য দেশ থেকে আমদানি করে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর