রবিবার, ২২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এমন হামলা হতে পারে না : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এমন হামলা হতে পারে না : প্রধানমন্ত্রী

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সহযোগিতা না থাকলে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা ঘটতে পারত না। আজ যারা গণতন্ত্রের কথা বলে, প্রকাশ্য দিবালোকে একটি দলের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করা, এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র ছিল? গতকাল সকালে ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার সপ্তদশ বার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শহীদ, ১৫ আগস্টের সব শহীদ এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং সম্ভ্রমহারা ২ লাখ মা-বোনের স্মরণে দাঁড়িয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই দেশের মানুষের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি তো আমার বাবার (বঙ্গবন্ধু) পথ ধরেই এদেশের মানুষের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছি। এদেশের মানুষের জন্য কাজ করছি। বারবার মৃত্যুকে সামনে থেকে দেখেছি। গ্রেনেড-বোমা-বুলেট দিয়ে বারবার আমাকে হত্যাচেষ্টা হয়েছে। বারবার আমার সামনে মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে। আল্লাহ একটা কাজ দেন, সেই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে বাঁচিয়ে রাখেন। আল্লাহর রহমতে নেতা-কর্মীরা আমাকে বারবার বাঁচিয়েছেন।

এই গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারসহ ওই সময়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার যুক্ত থাকা এবং ঘাতকদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হামলার দিন রাতেই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে করে চারজনকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার মধ্যে কারারক্ষী তাজউদ্দিনও ছিল। সেই সঙ্গে শোনা যায়, কর্নেল রশীদ আর ডালিম (বঙ্গবন্ধুর খুনি) সেই সময় ঢাকায় এসেছিল এবং তারা খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার তত্ত্বাবধানেই ছিল। কারণ গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআই, এনএসআই ও পুলিশ অফিসার সবাই এরমধ্যে জড়িত ছিল। তখনকার সরকার এদের রক্ষা করতে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। যখন জানল গ্রেনেড হামলায় আমি মরি নাই, বেঁচে আছি। তখন তারা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।’ ওই দিনের ঘটনা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেখানে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সাধারণত পুলিশ এগিয়ে আসে সাহায্য করতে, যারা আহত তাদের রক্ষা করতে। এখানে দেখা গেল উল্টো। বরং আমাদের নেতা-কর্মী দূরে যারা ছিল, তারা যখন ছুটে আসছে আহতদের বাঁচাতে, তাদের আসতে দেওয়া হয়নি। বরং টিয়ারগ্যাস মারা হয়েছে। ওই গ্যাসেও অনেকে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার মানেটা কী? যারা আক্রমণকারী, তাদের রক্ষা করা, তাদের রেসকিউ করার জন্যই এই টিয়ারগ্যাস মারা, লাঠিচার্জ করা। একটা সরকারের যদি সহযোগিতা না থাকে, তাহলে এ রকম ঘটনা ঘটতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে জজ মিয়া নামের দরিদ্র একজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। একটা ‘কাহিনি তৈরি করে’ তার পরিবারকে লালন-পালন করা হবে এই আশ্বাস দিয়ে। অথচ আর্জেস গ্রেনেড সংগ্রহ করা বা গ্রেনেড মারার মতো লোক সংগ্রহ করার সামর্থ্যই তার (জজ মিয়ার) ছিল না। পাশাপাশি ওই সময় মগবাজার আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেসকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করাসহ আওয়ামী লীগের কর্মীদের গ্রেফতার করে তাদের দিয়ে স্বীকার করানোর পরিকল্পনা হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের দলীয় কোন্দলেই এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। ওই দিনের ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন, একটা গ্রেনেড পাওয়া গেল জেলখানার ভিতরে দেয়ালের সঙ্গে। সেটা আবার আমাদের কোনো কোনো স্বনামধন্য পত্রিকা ডায়াগ্রাম এঁকে দেখাল যে, জেলখানার পাশের কোনো এক বাড়ি থেকে ওই গ্রেনেড ছুঁড়ে মারাতে ওটা ওখানে পড়েছে! জেলখানার পাশে এমন কোনো বাড়ি নেই যেখান থেকে গ্রেনেড মারলে ওই জায়গায় এসে পড়বে।’ তিনি বলেন, আসল কথা হলো এরা অনেক ক্রিমিনাল জোগাড় করেছিল। তার মধ্যে কিছু জেলখানা থেকে বের করে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু সে সময় প্রত্যেকের হাতে যে গ্রেনেডগুলো ছিল, সবাই সেগুলো মারতেও পারেনি। রমনা হোটেলের সামনে ওখানে একটা গলিতে একটা পাওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গায় কয়েকটা আলামত পাওয়া যায়। পরে তারা নিশ্চয় (কারাগারে) ঢুকে গিয়েছিল এবং একজন কারারক্ষী এর মধ্যে জড়িত ছিল।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আক্রমণকারীদের রক্ষা করার জন্য সেদিন ভয়াবহতার মধ্যেই পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস ছুড়েছে। সব আলামত সিটি করপোরেশনের গাড়ি দিয়ে ধুয়ে নষ্ট করা হয়। একটা গ্রেনেড অবিস্ফোরিত থেকে যায়, সেটিও সংরক্ষণের কথা বলায় একজন অফিসারকে ধমকানো হয়। পরে তাকে নির্যাতনও করা হয়। সরকারের সহযোগিতা না থাকলে তো এমন হতে পারে না। তিনি বলেন, গ্রেনেড হামলার পর চারদিকে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে একজন বিচারককে দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। সেই কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘পাশের দেশের গোয়েন্দা সংস্থা’ এসে এ ঘটনা ঘটিয়েছে!’ তিনি বলেন, পাশের দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এসে দিনেদুপুরে এভাবে এতগুলো গ্রেনেড যদি শহরের ভিতরে মেরে যেতে পারে, তাহলে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো কী করছিল? তারা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছিল? তাহলে তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে কীভাবে? আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার সশস্ত্র বাহিনী, আমাদের বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি), আমাদের পুলিশ- তারা কী করছিল? এভাবে তারা (তৎকালীন সরকার) সমস্ত দৃষ্টিটা অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করল।’

সেদিন আহতদের চিকিৎসা নিতেও যে বাধা দেওয়া হয়েছিল, সে কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সব থেকে দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপিমনা ডাক্তার, তারা কেউ মেডিকেল কলেজে ছিল না। জালাল (ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন) সেটা আমাকে বলল। আর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আহতকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বলেছে, এখানে ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসা নিতে পারবে না। সেটা সম্পূর্ণ বন্ধ। আর  ঢাকা মেডিকেল কলেজে বিএনপিমনা কোনো একটা ডাক্তারও সেদিন চিকিৎসা করেনি। আমাদের ডাক্তার রোকেয়া সেদিন আইভী রহমানসহ প্রায় ৭০ জনকে নিজে একা অ্যানেসথেসিয়া দিয়েছে। এমনকি গ্রেনেড হামলায় নিহতদের লাশ মেডিকেল কলেজ থেকে পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিতেও গড়িমসি করা হচ্ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সেখানে ঘিরে থাকলে কর্তৃপক্ষ ভোর রাতে লাশ দিতে বাধ্য হয়।

সে সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নানা ‘অপতৎপরতার’ কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘পরে আমি শুনেছি, ওখানে ডিজিএফআইর এক অফিসার নাকি ছিল ডিউটিরত। যখন এই গ্রেনেড হামলা হয়, সে হেডকোয়ার্টারে ফোন করে। তখন তাকে ধমক দেওয়া হয়। আর দু-একজন পুলিশ অফিসার, তারা ওখানে ছিল। তারা জানত না। তারা হয়তো পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ফোন করেছে। তাদেরও ধমক দিয়ে বলা হয়, এগুলো তোমাদের দেখা লাগবে না। তোমরা ওখানে কী কর? সরে যাও।’

গ্রেনেড হামলার পর সংসদে ওই ঘটনা নিয়ে কথা বলতে বাধা দেওয়ার ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা শোক প্রস্তাব সংসদে আমরা দিতে চাইলাম, সেটা প্রত্যাখ্যান করা হলো, নিল না। আমরা যারা কথা বলতে চেয়েছি, আমাদের কোনো মাইক দেওয়া হলো না। খালেদা জিয়া নিজে দাঁড়িয়ে বলল- ‘উনাকে (শেখ হাসিনা) আবার কে মারবে? উনি তো নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গেছে!’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় সংসদে দাঁড়িয়ে জবাবে আমি বললাম, আমার হাতে তো কোনো ভ্যানিটি ব্যাগও ছিল না, কিছুই ছিল না। আর আমি কবে এই আর্জেস গ্রেনেড মারায় এক্সপার্ট হয়ে গেলাম, তা তো জানি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কি সুইসাইড করতে গিয়েছিলাম ওখানে? আইভি রহমানসহ সবাইকে নাকি আমি গ্রেনেড হামলা করে মেরেছি! এ ধরনের কথা বলেন তিনি (খালেদা জিয়া)।’ তিনি বলেন, যারা গণতন্ত্রের কথা বলে, সেদিন (২১ আগস্ট) একটা দেশে যে ঘটনা ঘটল এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হলো। আমরা সেটার প্রতিবাদ করলাম। সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ ডাকলাম। মুক্তাঙ্গনে সভা হওয়ার কথা ছিল। অনুমতি দেয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আওয়ামী লীগ অফিসের সামনেই করব। পোস্টার করা হলো, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম আমরা। কিন্তু তারা (সরকার) মধ্যরাতে মুক্তাঙ্গনে করার অনুমতি দিল। তখনই সন্দেহ হলো কেন এত রাতে অনুমতি দিল? তাছাড়া আমাদের সমাবেশ করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে এভাবে আর্জেস গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা করবে, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ২১ আগস্টের কথা স্মরণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, সমাবেশ শেষ করামাত্র একজন ফটোগ্রাফার এসে তাদের ছবি নিতে অপারগতার কথা জানাতেই তিনি থমকে দাঁড়ালেন। মাইকটি তিনি হাত থেকে রাখতেও পারেননি, তখনই গ্রেনেড হামলা শুরু হয়ে যায়। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হওয়ার শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফসহ কয়েকজন ঘিরে ফেলেন। তিনি বারবার ওঠার চেষ্টা করলেও তাঁরা তাঁকে ছাড়েননি এবং তাঁর চশমাটি ছিটকে পড়ে যায়। তিনি বলেন, ‘হামলার পরে আমি দেখলাম আমার গায়ে শুধু রক্ত আর রক্ত। অর্থাৎ ওই যে গ্রেনেডের স্পিøন্টারগুলো সব এসে আঘাত করছে হানিফ ভাইয়ের মাথায় ও গায়ে। যেহেতু সে ধরে রেখেছে, তার রক্তে আমার শরীর ভেসে যাচ্ছে। তিনটি গ্রেনেড ফোটার পর কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে আবার। মনে হচ্ছে যেন, এর শেষ নেই, কেয়ামতের মতো। চারদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। জানি না আল্লাহ কীভাবে হাতে তুলে আমাকে বাঁচাল। আমার গায়ে একটাও স্পিøন্টার লাগেনি। কিন্তু আওয়াজে ডান দিকের কানে আর শুনতে পাচ্ছিলাম না।’ তিনি বলেন, ‘যখন আমি গাড়িতে উঠতে যাব, দরজাটা খুলে মাহবুব দাঁড়ানো (২১ আগস্ট শহীদ তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা), তখনই গুলি আসলো এবং সেই গুলিতে মাহবুব মারা গেল। আরও কয়েকটি গুলি এসে গাড়িতেও লাগল (বুলেট প্রুফ গাড়ি)। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের সঞ্চালনায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ প্রান্তের মূল অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কেন্দ্রীয় নেতা এবং বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও দক্ষিণের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মন্নাফী। 

বাংলাদেশকে আফগানিস্তান হতে দেব না : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে সজাগ ও সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে দেশে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের উত্থান হয়েছিল। তারা স্লোগান দিত ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। আমরা ওই আফগান হতে চাই না। বাংলাদেশ বাংলাদেশই হবে। বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। বাংলাদেশকে আফগানিস্তান হতে দেব না। গত রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ধারণকৃত এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার দিবস উপলক্ষে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার বিশেষ সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়। সাক্ষাৎকারটি নেন প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে টার্গেট করে ওই হামলা হয়। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতিসহ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে ফিরে আসা, গণতন্ত্র, মানুষের ভোট ও ভাতের জন্য তাঁর জীবনের সংগ্রামের কথা উঠে আসে এ সাক্ষাৎকারে।

২১ আগস্টের হামলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সমস্ত বাংলাদেশে ৫০০ জায়গায় বোমা হামলা হলো। ৬৪ জেলার মধ্যে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা হয়েছে। ঢাকা সিটিতেই ৩৫ জায়গায় বোমা হামলা হয়। সে সময় আমি টুঙ্গিপাড়া ছিলাম। বেলা ১১টার দিকে দিনাজপুর থেকে আমাদের একজন কর্মী ফোনে বললেন, আপা আমাদের এখানে বোমা হামলা হয়েছে। ঢাকাসহ আরও কয়েক জেলা থেকে বারবার ফোন আসছে। ইভেন, গোপালগঞ্জ থেকেও ফোন পেলাম সেখানে বোমা হামলা হয়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়ে গেলাম ঢাকার উদ্দেশে। একমাত্র মুন্সীগঞ্জে তখনো কিন্তু বোমা হামলাটা হয়নি। ওরা (জঙ্গিরা) সময়টা হিসাব করতে পারেনি। কারণ আমার রওনা হওয়ার কথা টুঙ্গিপাড়া থেকে বিকাল ৩টা-৪টার দিকে। মুন্সীগঞ্জ পৌঁছাতে বিকাল ৫টা-৬টা বাজবে। তবে আমি মুন্সীগঞ্জ দিয়েই ঢাকায় এসেছিলাম। অনেকে ফোনে মানা করেছেন যে ঢাকার সব জায়গায় বোমা। কোথায় যে বোমা পড়বে ঠিক নেই। আপনি এ সময় মুভ কইরেন না, আপনি থাকেন। আমি বলেছিলাম এ সময় আমাকে ঢাকায় যেতেই হবে। আমাকে থাকতেই হবে ঢাকায়। কারণ এতগুলো জেলা থেকে খবর আসছে, একটার পর একটা ফোন আসছে সমস্ত জেলা থেকে। মুন্সীগঞ্জ দিয়ে বিকালে আসব বলেই হয়তো সেখানে বোমা হামলা আগে হয়নি। কারণ নিশ্চয়ই তাদের ওটা একটা প্ল্যান ছিল যে আমি যখন পার হব তখন ওখানেই হবে, মারবে বা কিছু করবে। কারণ আমার যে সময় ফেরি ধরার কথা আমার জন্য তো ফেরি স্পেশাল থাকল ওটার একটা হিসাব তাদের ছিল। কিন্তু আমি তার আগেই চলে এসেছি। নরমাল যে রাস্তা দিয়ে আসি সেভাবে না এসে আমি এসে সোজা বিডিআরের ভিতর দিয়ে ঢুকে সুধা সদনে ঢুকি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি আমলে তো একটা সন্ত্রাসী দেশ করেই ফেলেছিল। সে সময় বহু লোক চলে যায় আফগানিস্তানে। তালেবানের ট্রেনিং নিতে।

 সেই মুফতি হান্নান নিজেই তো ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। তারপর এই তাজউদ্দিন, আরেকজন যে সেও তো ট্রেনিং নেওয়া। এ তো সব বিএনপির লোক। তাজউদ্দিন তো বিএনপির খাস এবং গ্রেনেড হামলার পর পর ওইদিন রাত ১১টার সময় চারজনকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসে তুলে দেয়। বিশেষ ব্যবস্থায় তারা চলে যায়। এবং সেখানে কিন্তু ডালিম আর রশীদও ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যার সঙ্গে যে জিয়াউর রহমান জড়িত এবং তার স্ত্রী যে তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছে এবং ছেলেকেও সেই একই পথে নামিয়েছে এটা তো স্পষ্ট।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বিএনপি আমলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস করে সেই তালেবান এবং সে সময় কিন্তু একটা স্লোগানও চলত বাংলাদেশে; তারা যে স্লোগান দিত আমি কোট করছি- ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। তিনি বলেন, আজকে আফগানিস্তানের অবস্থাটা দেখেই তারা দেখুক যে সেখানকার কী অবস্থা। সেটাই বাংলাদেশে করতে চেয়েছিল। যেটা হয়তো আমরা আছি বলে পারেনি। এটা আমাদের দেশের মানুষকেও আরও বুঝতে হবে। বিশেষ করে আমি বলব আমাদের তরুণসমাজকে ইতিহাস এবং শিকড়ের সন্ধান করে তাদের সে আদর্শ নিয়েই চলতে হবে যেন এই লাখো শহীদের রক্ত বৃথা না যায়। আর এ দেশের মানুষের জন্য তো আমার মা-বাবা সবাই জীবন দিয়ে গেছেন। আমার বাবার তো জীবনে কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। তিনি তো যা কিছু করেছেন এ দেশের মানুষের জন্যই করে গেছেন।

‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু ২১ আগস্ট নয়, আপনাকে হত্যার জন্য ২০ থেকে ২২ বার হামলা করা হয়েছে। এই যে এতবার আপনার ওপর হামলা, এত আক্রোশ কেন আপনার ওপর? এরা কারা?’ এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে যেখানেই গেছি সেখানে তো আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যেখানেই গেছি সেখানেই মানুষের ঢল নামত। কারণ ১৫ আগস্টের পর মানুষ কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু আমি আসার পরে মনে হলো মানুষের একটা জোয়ার চলে এলো। তিনি বলেন, আমি যখন খুলনা থেকে রাজশাহী রওনা হলাম এত মানুষ! মানুষের ঢল সব জায়গায়। পথে পথে মিটিং করতে করতে আমাদের এত সময় লাগল যে রাত ১১টার দিকে আমি ঈশ্বরদীতে গিয়ে মিটিং করি। যে মিটিং আমার বিকালে করার কথা। নাটোরে ঢুকব, নাটোরে আমার মঞ্চ ভেঙে দিল মিটিংয়ের, আগুন দিয়ে পোড়াল।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ১৫ আগস্টের পর আমাদের তো দেশে আসতে দেওয়া হয়নি। জিয়াউর রহমান রেহানার পাসপোর্টটা রিনিউ করতে দেয়নি। যেহেতু আমি দিল্লিতে ছিলাম দিল্লিতে হাইকমিশনার বাংলাদেশের ছিলেন শামসুর রহমান সিএসপি। আমাদের পাসপোর্টটা তিনি রিনিউ করে দিয়েছিলেন এবং আমরা যাতে দেশে আসতে না পারি সেই বাধা ছিল। তারপর যখন আওয়ামী লীগ আমাকে সভানেত্রী নির্বাচিত করে তখন তো আমি সিদ্ধান্ত নিই চলে আসবই।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ ছিল। আর জিয়াউর রহমান মার্শাল ল দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষেতাও গেল, সমাজতন্ত্র গেল সবই গেল। অর্থনৈতিক মুক্তিটুক্তি সবই বাদ। তো এই যে পরিবর্তনটা এটা কাদের খাতিরে করা? কারণ এরা ওই পরাজিত পাকিস্তানি শক্তি। তাদেরই তোষামোদি-খোশামোদি, তাদেরই পদলেহনকারী। কারণ তখন এসে গেছে মার্শাল ল। মার্শাল ল তো আর গণতন্ত্র নয়। কাজেই গণতন্ত্রও চলে গেল। তিনি বলেন, যারা আমাদের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে বাংলাদেশের যে মূল আদর্শ, যে লক্ষ্য, যে গরিবের জন্য কাজ করা, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো সেটাই তারা করতে চায়নি। বরং ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে একটা এলিট শ্রেণি তৈরি করে তাদের দিয়ে দেশ চালানো বা তাদের নিয়ে ক্ষমতায় থাকা। এবং ওই পাকিস্তানি একটা প্রদেশ হয়ে যাক আবার বাংলাদেশ সেটাই ছিল তাদের মানসিকতা।

সরকারপ্রধান বলেন, আর আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে তো বাংলাদেশ আজকে এগিয়ে গেছে। আমরা যদি মাত্র ১২ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে একটা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে পারি তাহলে জাতির পিতা যদি বেঁচে থাকতেন তো ৪০ বছর আগেই আমরা সেটা অর্জন করতে পারতাম। তো আমি এসে সেই আদর্শ নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু তারা তো সেটা চায়নি।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, সেই ’৮১ সালে আমি বাংলাদেশে নামার পর থেকেই আমার ওপর হামলা হচ্ছে আর আল্লাহ আমাকে কীভাবে যেন বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। হয়তো আমার... আল্লাহ তো সবার জন্য কিছু কাজ লিখে দেয়। হয়তো কিছু আমার ওপরে এই দায়িত্বটা আছে যে এই বাংলাদেশটাকে যেই মর্যাদাটা হারিয়ে গেছে সেই মর্যাদাটা ফিরিয়ে দেওয়া। আর এই যে দুঃখী মানুষের মুখে... গরিব-দুঃখী মানুষের জন্য আমার আব্বা যে কাজ করতে চেয়েছিলেন সেটা যেন হয়। এটাই বোধহয় আল্লাহর ইচ্ছা। আর সেটা যেন আমার হাত দিয়ে হয়। আল্লাহ সেটা চাচ্ছিলেন বলেই বারবার আমাকে হামলা থেকে বাঁচিয়েছেন এবং এই যে আমি যতটুকু সফলতা অর্জন করছি বা যতটুকু বাংলাদেশের জন্য করতে পারছি বা বাংলাদেশের গরিবের জন্য করতে পারছি এটাও আমি মনে করব যে একদিকে আমার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বাংলাদেশের জনগণ এবং ওপরে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের ইচ্ছায়। এটাই হলো বাস্তবতা। হ্যাঁ, আল্লাহ যত দিন হায়াত দিয়েছেন তত দিন বেঁচে থাকব। মৃত্যু তো অবধারিত। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে/চিরস্থির কবে নীর হায়রে, জীবন-নদে?’ এটা তো কবি বলে গেছেন। আর সেটাই আমি মনে করি।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ২১ আগস্টের বিয়োগান্ত দিনে দেশবাসীর উদ্দেশে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আর যতক্ষণ বেঁচে আছি দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাব। কারণ আমি তো দেশের মানুষের কাছে ওয়াদা দিয়েছি বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের। আমার বাবা-মা জীবন দিয়ে গেছেন এ দেশের মানুষের জন্য। আমি সেভাবে আমার জীবন দিতেও সব সময় প্রস্তুত। জনগণের দোয়া নিয়েই আমি চলি। আমার এ পথচলায় আমার একটাই লক্ষ্য- জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের দেশ- একটা উন্নত, সমৃদ্ধ, সুখী বাংলাদেশ গড়া। সে ক্ষেত্রে দেশবাসীর সহযোগিতা চাই, দোয়া চাই। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

সর্বশেষ খবর