আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে প্রতিদিনের মতো গতকালও বিক্ষুব্ধ নারীরা তালেবানবিরোধী মিছিল করেছেন। সশস্ত্র তালেবানরা এ সময় আগের দিনের মতোই শূন্যে গুলি ছুড়ে বিক্ষোভ ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এদিকে তালেবানের ঘোষিত নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে মানবে না বলে জানিয়েছেন উত্তরের প্রদেশ পানশিরের যোদ্ধারা। নতুন সরকার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে, এফবিআইর মোস্ট ওয়ান্টেড আসামিদের নিয়ে এ সরকার গঠন করা হয়েছে। সূত্র : আলজাজিরা, গ্লোবাল টাইমস, রয়টার্স, বিবিসি, এএফপি। প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, আগের দিনের মতো গতকালও কাবুলে সশস্ত্র তালেবানরা শূন্যে গুলি ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছে। এ সময় আফগান নারীরা রাস্তার পাশে হাঁটু মুড়ে সামনের দিকে ঝুঁকে নিজেদের রক্ষায় সচেষ্ট হন এবং পরে নিরাপদ স্থানে সরে যান। এর মধ্যেই এক নারী তাদের দিকে তাক করা ক্যামেরায় তাকিয়ে অনর্গল বলে যান তালেবান শাসনামল নিয়ে তার আপত্তি আর ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কথা। ওই নারী বলেন, ‘তালেবান খুব খারাপ, তারা মানুষই নয়। আমাদের বিক্ষোভের অধিকারটুকুও দিচ্ছে না। তারা মুসলিম তো নয়ই, তারা কাফের।’ খবরে বলা হয়, এ সময় তালেবানরা ভারী গুলিবর্ষণ শুরু করলে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের বেশ কয়েকটি ভিডিও ফুটেজে তালেবানরা ট্রিগার চেপে ধরার আগে তাদের হাতে থাকা বন্দুকগুলো শূন্যে তাক করে রাখতে দেখা গেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তালেবানরা কাবুল দখলের পর মাস পার হতে চললেও এ ধরনের বিক্ষোভ, প্রতিদিন দেশজুড়ে নারীদের নেতৃত্বে ছোট ছোট নানান প্রতিবাদ কর্মসূচি নতুন তালেবান সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়েই হাজির হচ্ছে। আফগানিস্তান জুড়ে কিছুদিনের বিক্ষোভগুলোতে অংশ নেওয়া নারীরা মূলত তাদের অধিকারের দাবিতেই সরব রয়েছেন। পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হেরাতের নারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, তারা নতুন সরকারে অধিকতর প্রতিনিধিত্ব এবং তাদের অধিকারের প্রতি যেন সম্মান দেখানো হয় তার জন্য জোর চেষ্টা চালাবেন। হেরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিজনেস স্কুলের শিক্ষার্থী দারিয়া ইমানি বলেন, সমাজে মর্যাদা ও চাকরি রক্ষার জন্য নারীদের বেরিয়ে আসতে হবে।
সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আহ্বান : আফগানিস্তানে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তালেবান বিরোধীরা। তারা গত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এ আহ্বান জানান। তারা এ সরকারকে মানবেন বলেও উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া রাজধানী কাবুলের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত পানশির উপত্যকায় তালেবানবিরোধী যোদ্ধারা নতুন এই সরকারকে অবৈধ বলেছেন। তারা বলছেন, আফগান জনগণের সঙ্গে এটা স্পষ্টই তালেবানের শত্রুতার ইঙ্গিত প্রকাশ করছে। প্রসঙ্গত, এর আগে তালেবানরা দাবি করেছিল, তারা ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টকে (এনআরএফ) পরাজিত করে পানশিরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। কিন্তু এনআরএফ বলছে, তারা এখনো যুদ্ধ করছে।
মোস্ট ওয়ান্টেড যারা : গত মঙ্গলবার ঘোষণা হওয়া আফগান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ৩৩টি পদেই রয়েছেন তালেবান ও তার সহযোগী গোষ্ঠীর সদস্যরা, যাদের অনেকের নাম রয়েছে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার তালিকায়, রয়েছেন ওয়াশিংটনের নজরে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আসামিও। নতুন সরকারে কোনো নারীকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। তালেবানের নতুন সরকারে কোনো নারীকে রাখা হয়নি বলে এরই মধ্যে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সমালোচনা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব মুজাহিদকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। হাক্কানি নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে সিরাজুদ্দিন হাক্কানি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইর ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আসামির তালিকায় রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে ঘোষণা রয়েছে মোটা অঙ্কের পুরস্কার। সিরাজুদ্দিন হাক্কানিকে গ্রেফতার করা সম্ভব- এমন তথ্য দিতে পারলেই ১ কোটি ডলার (৮৫ কোটি টাকা প্রায়) পর্যন্ত পুরস্কার দেবে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। এফবিআইর বিশ্বাস, সিরাজ হাক্কানির সঙ্গে আল-কায়েদার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে।বিশ্বের প্রতিক্রিয়া : আফগানিস্তানে তালেবানের নতুন সরকার নিয়ে মিশ্র ও সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে নানা দেশ ও সংস্থা। তবে সরকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তালেবান নতুন সরকার ঘোষণার পর পরই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি (আফগানিস্তানে) ঘোষিত নামের তালিকায় কেবল তালেবান সদস্য বা তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা রয়েছেন এবং কোনো নারী নেই। আমরা (এদের মধ্যে) কিছু লোকের অন্তর্ভুক্তি ও অতীত ইতিহাস নিয়েও উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, আমরা বুঝতে পারছি, এটিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে উপস্থাপন করেছে তালেবান। তবে আমরা তাদের কথায় নয়, কাজ দিয়ে বিচার করব। জাতিসংঘের নারী সংস্থার প্রধান প্রমিলা প্যাটেন বলেন, আফগানিস্তানের নতুন সরকার থেকে নারীদের বাদ দেওয়া তালেবানের ‘নারী অধিকার রক্ষা ও সম্মান’-এর প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণকে ‘লিঙ্গ সমতা ও প্রকৃত গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার থেকে নারীদের বাদ দিয়ে তালেবান নেতৃত্ব তাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্য সম্পর্কে ভুল সংকেত পাঠিয়েছে। এদিকে তালেবান ইস্যুতে অনেকটা একই সুর শোনা গেছে চীনেরও।
চীনারা এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও দেশটিতে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, আপাতত আফগানিস্তানের নতুন শাসকদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে চীন। তালেবান তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে কি না তা দেখতে চায় বেইজিং। চীনা বিশ্লেষকরা সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, আফগানিস্তানে নতুন যে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা হয়েছে, তাতে দেখা যায় দেশটিতে তালেবান তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য ও নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে চায়। এর মানে হলো, এ মুহূর্তে তালেবান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা পূরণের বদলে অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান জানিয়েছেন, তারা আফগানিস্তানের পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখছেন। কঙ্গো সফরকালে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা জানি না (আফগানিস্তানের) এ অন্তর্বর্তী সরকার কত দিন থাকবে। আমাদের এ প্রক্রিয়াটি সাবধানে অনুসরণ করতে হবে। কাতারের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, তালেবান এখন ‘বাস্তববাদী’ মনোভাব দেখাচ্ছে এবং কাজের মাধ্যমেই তাদের বিচার করা উচিত। তার মতে, সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি যে আফগানিস্তানের একচ্ছত্র শাসক, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, সরকারের স্বীকৃতির সঙ্গে বৈশ্বিক এই সংস্থাটির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটি সদস্য দেশগুলোই করে, আমরা নই। তালেবানের সরকার ঘোষণা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, কেবল আলোচনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নিষ্পত্তির মাধ্যমেই আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি আনা সম্ভব। মুখপাত্র জানান, আফগানিস্তানে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে অবদান রাখতে, সব আফগান, বিশেষ করে নারী অধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ও জীবন রক্ষাকারী মানবিক সহায়তা প্রদানে সংস্থাটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।