রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
জাহাঙ্গীর বললেন

আমি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

আমি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ও বরখাস্ত সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, আমি আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক হিসেবে থাকতে চাই। তিনি দাবি করে বলেন, আমি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।

শুক্রবার রাতে রাজধানীর বনানীতে একটি অফিসে বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে তিনি এ কথা বলেন।

দল থেকে বহিষ্কার ও প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া এবং মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হওয়াসহ তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত নানা অভিযোগ নিয়ে কথা বলেন তিনি। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও আমার অভিভাবক যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমি মাথা পেতে মেনে নিয়েছি। আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুকন্যা একদিন আসল সত্যটা জানবেন। তখন তাঁর ভুল ভাঙবে। তিনি বলেন, আমি জাতির পিতাকে নিয়ে কোনো নেতিবাচক কথা বলিনি। আমার আড়াই-তিন ঘণ্টার কথাকে সুপার এডিট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের মুখে জাতির পিতার কথা শুনে এবং স্কুলজীবন থেকে ছাত্ররাজনীতি- অদ্যাবধি জাতির পিতাই আমার আদর্শ। তাঁর আদর্শ নিয়েই রাজনীতি করে এসেছি। কাজেই তাঁকে কটাক্ষ করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। করিওনি। কিন্তু আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আমার বিভিন্ন বক্তব্যকে সুপার এডিট করে আমাকে ঘায়েল করেছে। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা ছড়িয়ে তারাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। যারা জাতির পিতার নামে এ মিথ্যাচার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিল তাদেরও শাস্তি চাই। ২২ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। চার মিনিটের ওই ভিডিওতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের নিয়ে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীর আলম। এরপর গাজীপুরের মেয়রের শাস্তি দাবিতে মশালমিছিল হয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয় এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা। গাজীপুরের পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রথমে মেয়রকে শোকজ করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ থেকে আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় দল। সেই সঙ্গে দলে তার প্রাথমিক সদস্যপদও খারিজ করা হয়। ২৫ নভেম্বর বিভিন্ন অভিযোগ এনে মেয়র পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ২২ সেপ্টেম্বর ফেসবুকে আপনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে আপনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে ‘বিতর্কিত’ বক্তব্য দিয়েছেন।

জাহাঙ্গীর আলম : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মহান স্থপতি। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের মুখে জাতির পিতার আদর্শের কথা শুনতাম। স্কুলজীবনে মহান নেতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করি। স্কুল ছাত্রলীগ, কলেজ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম। এরপর দলীয় মনোনয়নে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, এরপর গাজীপুর সিটি করপোরেশনে নৌকা নিয়ে বিশাল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হই। এরপর শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে গ্রামকে শহর করতে নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করি। ‘বাংলাদেশের একজন মানুষও ক্ষুধার্ত থাকবে না, গৃহহারা থাকবে না। বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পাবে না।’ জাতির পিতার এই মহান বাণী স্মরণে রেখে শত শত গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীর পড়ালেখার ব্যবস্থা করি। অনেক বেকারের কর্মসংস্থান করি। মানুষের কল্যাণেই কাজ করছি। ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়ককে যানজটমুক্ত করতে নিজস্ব ট্রাফিক ব্যবস্থা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, খুব কম সময়েও আমি সফলতা অর্জনের কাছাকাছি এসেছিলাম। এতে স্থানীয় রাজনীতিতে কারও কারও চক্ষুশূল হতে থাকি। সে কারণে আমাকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার পথ খুঁজছিলেন তারা। সে পথ তারা বেছে নেন একটি ভিডিও। যেখানে আমার তিন ঘণ্টার কথা কেটে একত্রিত করে ‘তিন মিনিট’ বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেন। এতে আওয়ামী লীগ ও জাতির পিতার আদর্শের মানুষ কষ্ট পায়। ভিডিওতে যেভাবে আমার বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে আমি তা বলিনি। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কথাগুলো একত্রিত করে তথ্য বিকৃত করা হয়েছে। এখানে আমাকে ভিকটিম করার চেয়ে মূলত জাতির পিতাকে তারাই ছোট করেছেন। তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। জাতির পিতাকে অবমাননা করেছেন। আমাকে জাতির সামনে ছোট করেছেন। এটা ডিজিটাল আইনের আওতায় পড়ে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : তাহলে ভিডিওটা ছড়িয়ে দেওয়ার পর কেন মামলা করলেন না?

জাহাঙ্গীর আলম : আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ভিডিওটি পুঁজি করে একটি পক্ষ গাজীপুরকে অচল করার পাঁয়তারা করছিল। আমি সে সময় যদি মামলা করতাম অথবা আমার পক্ষে কেউ মামলা করত তাহলে শিল্প এলাকা গাজীপুর আরও বেশি অচল হয়ে পড়ত। বিষয়টি নিয়ে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিলে মূলত প্রভাবটা পড়ত আমাদের শিল্পে। যেখানে ২৫০০-২৬০০ গার্মেন্ট রয়েছে। ১৭০০ বায়ার। প্রায় ২১ লাখ শ্রমিক থাকে। গার্মেন্ট শিল্পে এর প্রভাব পড়লে আমার দেশেরই ক্ষতি হতো। সে সময় নেত্রীও (প্রধানমন্ত্রী) দেশের বাইরে ছিলেন। আমি পাল্টাপাল্টি কিছু করতে গেলে যদি নেত্রী যদি আমাকে কিছু বলেন। সে কারণেই মামলাসহ পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিইনি।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : জাতির পিতাকে অবমাননা ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের নিয়ে ‘বিতর্কিত’ বক্তব্য দেওয়ায় আপনার বিরুদ্ধে রাজবাড়ী, মাদারীপুর ও পঞ্চগড়ে মামলা হয়েছে। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

জাহাঙ্গীর আলম : আমি আগেই বলেছি জাতির পিতাকে নিয়ে আমি কোনো ধরনের অবমাননাকর বক্তব্য দিইনি। আর আমার কক্ষে তিন ঘণ্টার বিভিন্ন আলাপচারিতা সুপার এডিট করে তিন মিনিটে ছড়িয়ে দিয়ে প্রতিপক্ষই জাতির পিতা এবং শহীদদের অবমাননা করেছেন। মামলা হলে তাদের বিরুদ্ধেই হওয়া উচিত। কারণ তারাই জাতির পিতাকে অবমাননা করেছেন। এতে সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে। আবার আমারও গোপনীয়তা লঙ্ঘন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা হচ্ছে, কেন হচ্ছে সব জানি। গাজীপুরে দেশের ৬৪ জেলার মানুষই বসবাস করে। আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাদের দিয়ে বিভিন্ন স্থানে মামলা করাচ্ছেন। আমার প্রতিপক্ষ আমার চেয়ে দলকেই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছেন। আমার অভিভাবক বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেলে সব বলব। হয়তো সেদিন নেত্রীকে সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারব।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি কি বলতে চান নেত্রীর কাছে সঠিক তথ্য যায়নি?

জাহাঙ্গীর আলম : নেত্রীর কাছে কাটাছেঁড়া তথ্য গেছে, এর বেশি কিছু বলব না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : স্থানীয়দের অভিযোগ- আপনি ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতি করেছেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মেয়র হওয়ার পর জামায়াত-শিবিরসহ বিএনপি নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন।

জাহাঙ্গীর আলম : আমার ভুলত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু কখনো অন্য সংগঠন করেছি, কেউ প্রমাণ দিতে পারলে জীবনে কাউকে মুখ দেখাব না। জাতির পিতা আমার আদর্শ। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আমার একমাত্র অভিভাবক। আমি কখনই জামায়াত-শিবির বা বিএনপিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিইনি। যারাই এ অভিযোগ করছেন তারা মিথ্যাচার করছেন। এখন কেন এসব অভিযোগ? হয়তো যারা আমাকে দিয়ে অন্যায় কোনো কাজ হাসিল করতে পারেননি তারাই এমন অভিযোগ করছেন। স্কুল ছাত্রলীগ, কলেজ ছাত্রলীগসহ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম। তা-ও বিরোধী দলের সময়ে। সুসময়ে নয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে আপনি সাধারণ ঝুট ব্যবসায়ী থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন! একই সঙ্গে মেয়র হওয়ার পর ট্রেড লাইন্সেস দেওয়ার নামে ব্যবসায়ীদের জিম্মি ও শেয়ার লিখে নিতেন।

জাহাঙ্গীর আলম : কোটি কোটি টাকা তো দূরের কথা। এক কোটি টাকার ওজন কত? এটা কি জানেন? তথ্য যাচাই না করেই সংবাদ প্রচার করা কি গণমাধ্যমের কাজ? হ্যাঁ, আমি ঝুট ব্যবসা করি। এটা কি হারাম? কোনো ব্যবসাই হারাম নয়। হাদিসেও ব্যবসাকে হালাল বলা হয়েছে। হালাল ব্যবসা করার আমার কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে। এ ব্যবসা দাঁড় করাতে ঋণ নিয়েছি। আমি কোটি কোটি টাকার মালিক না। একজন সফল ব্যবসায়ী বলতে পারেন। আর মেয়র হওয়ার পর ট্রেড লাইন্সেস নবায়ন কিংবা ট্টেড লাইন্সেস নিতে কোনো ব্যবসায়ীকে হয়রানি করা হয়নি। জিম্মি করার প্রশ্নই আসে না। আর শেয়ার লিখে নেওয়ার একটি প্রমাণও কেউ দিতে পারবে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দলীয় পদ থেকে বহিষ্কারের পর কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

জাহাঙ্গীর আলম : মেয়র পদের চেয়ে আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক থাকা আমার কাছে বড়। যেসব কারণে মেয়র থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এর একটির সঙ্গেও আমি জড়িত নই। আর দল থেকে বহিষ্কার? আগেই বলেছি, আমি জাতির পিতা এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে এমন বক্তব্য দিইনি। আমি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। তার পরও উন্নত বাংলাদেশের রূপকার, মানবতার মা, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার একটাই দাবি- আমি আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক হিসেবে থাকতে চাই।

সর্বশেষ খবর