শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা উপেক্ষিত

নার্স সংকটে বিপাকে স্বাস্থ্যসেবা

♦ প্রয়োজনের তুলনায় নিয়োগ কম ♦ সেবা নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই ♦ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নার্সিং পেশায় উদ্বুদ্ধ করতে নানা উদ্যোগ

জয়শ্রী ভাদুড়ী

সুনামগঞ্জের শাল্লায় প্রায় দেড় লাখ মানুষের বসবাস। হাওর এলাকার এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মাত্র ১৮ জন নার্স সেবা দেন এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে। শুধু এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নয়, সারা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে সংকট রয়েছে নার্সের। প্রায় ৩ লাখ নার্সের প্রয়োজন থাকলেও সারা দেশে নিবন্ধিত নার্স রয়েছেন মাত্র ৮২ হাজার। অপ্রতুল নার্স এবং প্রশিক্ষণের অভাবে সঠিক সেবা ও মার্জিত আচরণ পাচ্ছেন না রোগীরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স নিয়োগ দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত ডাক্তারের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৯৯৭ জন। এই সংখ্যক চিকিৎসকের বিপরীতে দেশে ৩ লাখের বেশি নার্সের প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের (বিএনএমসি) তথ্য অনুসারে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত নার্স ও মিডওয়াইফের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার জন। অর্থাৎ দেশে প্রয়োজনের মাত্র ২৭ শতাংশ নার্স রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) বর্তমানে ২ হাজার ৬০০ শয্যার বিপরীতে দিনে সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকে। সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৫০০ রোগীও ভর্তি ছিল এ হাসপাতালে। অতিরিক্ত রোগী হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা ও সিঁড়ির পাশে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেয়। এর সঙ্গে বহিঃবিভাগের রোগী তো রয়েছেই। এই রোগীদের সেবা দিতে হাসপাতালে নার্স রয়েছেন ২ হাজার ৮০০ জন। বিপুল সংখ্যক রোগীর সেবা দিতে গিয়ে অনেক সময় পর্যাপ্ত সেবা পান না রোগীরা। অনেক সময় দুর্ব্যবহারেরও শিকার হন তারা। ঢামেকের নিউরোসার্জারি বিভাগের আওতায় তাহমিনা বেগমের ছেলে ভর্তি আছে। তিনি বলেন, অনেক সময় নার্সদের ডেকে পাওয়া যায় না। রাতে রোগীর অবস্থা খারাপ হলে তাদের ডাকলে খুবই খারাপ ব্যবহার করে। অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ এই হাসপাতালে সেবা নেওয়ায় এগুলোর কোনো বিহিত হয় না। বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতাল শাখার সভাপতি মোহাম্মদ কামাল হোসেন পাটওয়ারী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা মহামারী মোকাবিলায় নার্সরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা নয়জন সহকর্মীকে হারিয়েছি। আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। এই সরকারের সময়ে নার্স নিয়োগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী এখনো সংকট আছে।’ বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের (বিএনএমসি) ডেপুটি রেজিস্ট্রার রাশিদা আক্তার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে বিএসসি ও ডিপ্লোমা নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি সরকারি কলেজ রয়েছে ৩৬টি, বেসরকারি কলেজ রয়েছে ৬৮টি। উচ্চতর পড়াশোনার জন্য রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান। এ বছর ৩৩ হাজার শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানে। এখন আসন বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই।’ প্রশিক্ষিত নার্স তৈরি এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের বৃত্তির ব্যবস্থা করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। রোটারি ক্লাব অব ঢাকা কারওয়ানবাজারের সমন্বয়ে আরও বেশ কয়েকটি ক্লাব এই বৃত্তি প্রদান করছে। এই শিক্ষার্থীদের নার্সিং ইনস্টিটিউটে পড়াশোনার সার্বিক খরচ বহন করছে ক্লাবগুলো। বৃত্তির আওতায় এ পর্যন্ত ১২ জন নার্সিংয়ে বিএসসি এবং ১০ জন ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়োগ পেয়েছেন। আরও ৪৩ জনের পড়াশোনা চলমান রয়েছে। পিছিয়ে পড়া নারীদের ক্ষমতায়ন এবং নার্সিং পেশার উৎকর্ষতা বাড়াতে এই উদ্যোগ নিয়েছে সংগঠনটি। নার্সিং বৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষা বৃত্তি দিয়ে আসছে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল। এ বিষয়ে এইচবি বি এইচ ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজের অ্যাডভাইজার অধ্যাপক মেজর (অব.) বদরুলওয়ারা বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার নার্সিং পেশাকে আধুনিক ও সম্মানজনক পেশায় উন্নীত করেছে। দেশ-বিদেশে নার্সের অনেক চাহিদা রয়েছে। তবে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলাতে নার্সিং প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে ইংরেজি, ক্লিনিক্যাল প্রাকটিসে দক্ষতা বৃদ্ধি, ত্যাগ, সততায় জোর দিতে হবে। এসব বিষয়ে সরকারি বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে বিশেষভাবে কাজ করা উচিত। আমরা প্রত্যেক নার্সকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল হিসেবে দেখতে চাই।’ দেশে প্রতি বছর চাকরির বাজারে প্রবেশ করে প্রায় ১৫ হাজার নার্স। কভিড পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার গত বছর প্রায় ৬ হাজার নার্স নিয়োগ দেয়। প্রায় ৫৫ হাজার নার্স সরকারি হাসপাতালগুলোতে চাকরি করেন। বাকিরা বেশিরভাগই বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করছেন। নিয়োগ বিধিমালায় অভিজ্ঞতা জানানোর কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে নিয়োগের সময় আগের অভিজ্ঞতা না জেনে নিয়োগ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। আগে দীর্ঘ দিন আইসিইউ, সিসিইউ কিংবা ডায়ালাইসিস ইউনিটে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও তাদের নিয়োগ দিয়ে পাঠানো হচ্ছে বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইসমত আরা পারভীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে নার্স সংকট আগের চেয়ে এখন অনেক কম। গত ১০ বছরে কয়েক দফা নিয়োগে সংকট অনেকটাই নিরসন করেছে সংকট। এখন আইসিইউ, সিসিইউ সেবা দিতে নার্সদের বিশেষায়িত ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। আগে তো ওরিয়েন্টশন ট্রেনিংয়েরও বালাই ছিল না। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণে জোর দিলে রোগীরা আরও ভালো মানের সেবা পাবে।’

সর্বশেষ খবর