বৃহস্পতিবার, ২৮ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

বাণিজ্য ঘাটতিতেই বড় দুশ্চিন্তা

♦ আমদানি নিয়ন্ত্রণে সতর্কাবস্থা ♦ ডলার সংগ্রহে নানামুখী উদ্যোগ

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ইউক্রেন যুদ্ধ সরকারের অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিচ্ছে। বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে সামষ্টিক অর্থনীতিতে। মূল্যস্ফীতি, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এখন সরকারের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাড়তে থাকা বাণিজ্য ঘাটতি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে যেখানে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, তা মে-তে বেড়ে প্রায় ৩১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অর্থবছর শেষের তথ্য পাওয়া গেলে এ ঘাটতি আরও বড় হবে বলে আশঙ্কা করছে খোদ অর্থ বিভাগ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতিরিক্ত আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে যেমন ডলারের দাম বাড়ছে, দেশি মুদ্রা টাকাও তার শক্তি হারাচ্ছে। অর্থনীতিতে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ উদ্যোগ হিসেবে আমদানি নিয়ন্ত্রণে সতর্কাবস্থা গ্রহণ করেছে সরকার, বহিঃখাত থেকে ডলার সংগ্রহেও নানামুখী উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিতে কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। এর ফলে জ্বালানি, খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। আবার যে পরিমাণ আমদানি ব্যয় বেড়েছে সে তুলনায় রপ্তানি আয় বাড়েনি। এ ছাড়া প্রণোদনা সুবিধা বাড়ানোর পরও রেমিট্যান্স আয় আশানুরূপ বাড়ছে না। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। এ পরিস্থিতিতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বাজেট ও প্রকল্প সহায়তা পাওয়ার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) যেখানে পণ্য রপ্তানি আয় ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার, সেখানে একই সময়ে পণ্য আমদানিতে ব্যয় ছিল ৭৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। করোনা মহামারির পর যেখানে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৩৩ শতাংশ হারে, সেখানে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩৯ শতাংশ। আবার এপ্রিল পর্যন্ত প্রবাসী আয় ছিল গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ কম। একদিকে আমদানি ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে, অন্যদিকে রেমিট্যান্স আয় কমছে যুদ্ধের কারণে- অর্থনীতির এ বিপরীতমুখী প্রবণতা দেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাণিজ্য ঘাটতি যেভাবে বাড়ছে তা উদ্বেগজনক। কারণ এর ফলে শুধু ডলারের দাম বাড়ছে তাই নয়, টাকার মূল্য অস্বাভাবিক কমে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। উপরন্তু মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া এটি ব্যালান্স অব পেমেন্টেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’ এজন্য অপ্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় কমাতে অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটের এক্সচেঞ্জ রেট (ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার) নিয়মিত মনিটরিংয়েরর পরামর্শ দেন এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)-এর সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক।

আমদানি নিয়ন্ত্রণে সতর্কাবস্থা, ডলার সংগ্রহে নানামুখী উদ্যোগ : বাংলাদেশ ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি ব্যয় কমাতে এরই মধ্যে সরকার অপ্রয়োজনীয় বিলাসী পণ্যের শুল্ক বাড়িয়েছে। পণ্য আমদানিতে ব্যাংকগুলোকে নগদ মার্জিন বাড়ানো হয়েছে। কিছু কিছু পণ্যে এলসি মার্জিন শতভাগ বাড়ানো হয়েছে। এমনকি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যাতে আমদানির এলসি খোলার ক্ষেত্রে সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করে সে বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশনা গেছে। সূত্র জানান, বড় এলসি খোলার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে ৫০ লাখ টাকার বেশি এলসি হলেই তা ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় মনে হলে এ ধরনের এলসি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বলেও জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা।

অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আমদানি ব্যয় সামাল দেওয়ার জন্য অভ্যন্তরীণ নীতির পাশাপাশি ডলার সংগ্রহে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে অপ্রত্যাবাসিত রপ্তানি আয় সময়মতো প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বাজেটে রেমিট্যান্স প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোয় বার্তা দেওয়া হয়েছে, তারা যেন প্রবাসীদের বৈধ পথে ডলার পাঠাতে নানামুখী প্রচার অব্যাহত রাখে। এ ছাড়া সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং প্রকল্প সহায়তা ও বাজেট সহায়তা থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রাও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পারে। এ ধরনের সহায়তা পেতে এরই মধ্যে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। গত এক সপ্তাহে অন্তত দুটি দাতা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে অর্থ বিভাগে বাজেট সহায়তা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর আলোচনা হয়েছে বলেও জানান কর্মকর্তারা।

 

সর্বশেষ খবর