সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতিহাস বদলে দিলেন মিরাজ

ভারতের বিরুদ্ধে ১ উইকেটে রুদ্ধশ্বাস জয় টাইগারদের

মেজবাহ্-উল-হক

ইতিহাস বদলে দিলেন মিরাজ

অবিস্মরণীয় জয় ছিনিয়ে আনার পর উল্লাস মিরাজের -রোহেত রাজীব

ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ মানেই কি ট্র্যাজেডি? বারবার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা! না! এবার আর কষ্টে নীল হতে হয়নি বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের! ইতিহাস বদলে দিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। একাই বীরদর্পে লড়াই করে ১ উইকেটে রুদ্ধশ্বাস এক জয় এনে দিলেন বাংলাদেশকে।

শেষ উইকেট জুটিতে মুস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে গড়লেন ৪১ বলে ৫১ রানের ক্যারিশম্যাটিক এক জুটি। ১৮৭ রানের টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে ৪ উইকেটে ১২৮ রান। এরপর মাত্র ৮ রানের মধ্যে ৫ উইকেট পড়ে যায় বাংলাদেশের। পরাজয় যেন নিশ্চিত হয়ে যায়। এরপর শেষ উইকেটে মহাকাব্যিক জুটি। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে শেষ উইকেটে ৫৮ রানের

অবিশ্বাস্য এক জুটিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। তখন উইকেটে ছিলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও পেসার শফিউল। তবে সেই ঘটনাকেও যেন ছাপিয়ে গেল মিরাজ-মুস্তাফিজের কালকের কীর্তি। ম্যাচ শেষে মিরাজ বলেন, ‘আমি যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। খুবই রোমাঞ্চিত। মুস্তাফিজ আমাকে দারুণ আত্মবিশ্বাসী করেছে। সে আমাকে বলেছে, আমাকে নিয়ে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। বল যদি আমার গায়েও লাগে, তা ঠেকিয়ে দেব। আমি আউট হব না। মুস্তাফিজের এই আত্মবিশ্বাসটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। আমাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। আজকের এই পারফরম্যান্স আমার ক্যারিয়ারে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ মিরাজ ৩৯ বলে অপরাজিত ৩৮ রান! ওয়ানডের পরিসংখ্যানে এই রান হয়তো কিছুই নয়! কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এই ৩৮ রানের ইনিংসটাই নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করল। ভারতের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে হারের যে মনস্তাত্ত্বিক বাধা তৈরি হয়েছিল সেটিও দূর হয়ে গেল। এই ম্যাচে মিরাজ মহানায়ক হলে নিশ্চয়ই নায়কের মর্যাদা পাবেন মুস্তাফিজুর রহমান। তবে সেটা তার বোলিংয়ের জন্য নয়। ১১ বলে অপরাজিত ১০ রানের ছোট্ট এক ইনিংস দিয়ে তিনি যেন বাঙালির হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। কী দারুণভাবে তিনি সঙ্গ দিয়েছেন মিরাজকে। অবিশ্বাস্য এই জয়ে সিরিজে ১-০-তে এগিয়ে গেল লাল-সবুজরা। শেষ দুই মাচের মধ্যে একটিতে জিতলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে সিরিজ। ক্রিকেটে সত্যিই দারুণ এক ‘ফানি গেম’। কে ভেবেছিল ১৩৬ রানে ৯ উইকেট হারানোর পর জিতবে বাংলাদেশ? কারণ, প্রতিপক্ষ ভারত মানেই তো হার! বারবার তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার গল্প। কলম্বোর নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে শেষ বলে ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে হারিয়েছিল ভারত। তারপর ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে শেষ পরাজয়। ২০১৮ সালে এশিয়া কাপের ফাইনাল এবং সবশেষ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বিশ্বকাপেও জেতা ম্যাচে হার। তবে এবার উল্টো ঘটনা ঘটিয়ে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। যেন হারা ম্যাচে এনে দিলেন দারুণ এক জয়। ক্রিকেটে কখনো কখনো এমন সব ঘটনা ঘটে, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

কে ভেবেছিল মাঝপথে এভাবে ভেঙে পড়বে বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ। যখন দায়িত্ব নিয়ে ব্যাট করার কথা তখনই ব্যর্থ দুই সিনিয়র মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিম। উইকেটে সেট হয়ে যাওয়ার পরও মাহমুদুল্লাহর মতো অভিজ্ঞ তারকা শার্দুল ঠাকুরের বলে নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। ১৪ রানেই তার ইনিংস শেষ। এমন সময়ে মুশফিক যেন নিজেকে বিলিয়ে দিলেন। মোহাম্মদ সিরাজের শট বল টেনে নিয়ে উইকেটে লাগিয়ে ‘প্লেড-অন’। ৪৫ বলে ১৮ রানে আউট মুশফিক। এরপর শেষ সুযোগ ছিল মিরাজ-আফিফ জুটির। বাউন্ডারির কোনো দরকারই ছিল না। ওভারে কয়েকটি করে সিঙ্গেল রান নিলেই ম্যাচ বের হয়ে যায়। কিন্তু এমন সময় বিলাসী শট খেলতে গিয়ে ক্যাচ হলেন আফিফ। দুই পেসার ইবাদত হোসেন ও মাহমুদ হাসান বাইশগজে গিয়ে রানের খাতাই খুলতে পারলেন না। ইবাদত হিট আউট, হাসান লেগ-বিফোর। কিন্তু এরপরই আসে স্মরণীয় সেই মুহূর্ত। একা লড়তে থাকেন মেহেদী হাসান মিরাজ। কিন্তু তার একার পক্ষে আর কত দূর যাওয়া সম্ভব। একে তো শেষ উইকেট জুটি, তার ওপর অন্যপ্রান্তে মুস্তাফিজুর রহমান। সিঙ্গেল রান নেওয়ারও সুযোগ নেই। এমন সময় কানায় কানায় পূর্ণ শেরেবাংলার গ্যালারি যে ফাঁকা হয়ে যায়। তবে কিছু দর্শক তখনো আশা হারাননি। তারা শেষ পর্যন্ত ছিলেন। আর তারাই দেখলেন মহাকাব্যিক এই বিজয়। তবে গতকাল এমন ইতিহাস গড়ার উপলক্ষটা এনে দিয়েছিলেন বোলাররাই। সাকিব আল হাসানের ঘূর্ণি আর ইবাদত হোসেনের পেস বোলিংয়ে পরাস্ত ভারতের পরীক্ষিত ব্যাটিং লাইনআপ গতকাল গুঁড়িয়ে যায় মাত্র ১৮৬ রানেই। ৪১.২ ওভারেই অলআউট। সাকিবের ঘূর্ণিতেই দিশাহারা হয়ে যান ভারতীয় ব্যাটাররা। ১০ ওভারে মাত্র ৩৬ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। ওয়ানডেতে ভারতের বিরুদ্ধে বাঁ-হাতি কোনো স্পিনারের সেরা বোলিং ফিগার। সাকিবের ঘূর্ণিতে নাকাল হয়ে ভারতের সেরা তারকা বিরাট কোহলি নিজের স্কোরকে ডাবল ফিগারেই নিয়ে যেতে পারেননি। দুর্দান্ত একই ডেলিভারিতে ৯ রানেই কোহলিকে ড্রেসিংরুমের পথ ধরিয়ে দেন। ক্যাপ্টেন রোহিতকে ২৭ রানে আউট করেন তিনি। এরপর ব্যাট হাতে খেললেন ২৯ রানের ইনিংস। দারুণ বোলিং করেছেন ইবাদত হোসেনও। তিনি নিয়েছেন ৪৭ রানে চার উইকেট। তবে কালকের ম্যাচে কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারি যেন একটা বারতাই দিল, বিশ্বকাপের জন্য ফুটবল নিয়ে ম্যাডনেস থাকলেও ক্রিকেট বাংলার মানুষের প্রাণের খেলা হয়েই আছে। ক্রিকেটের আবেদন যেন একটুও কমেনি। বরং এমন অবিশ্বাস্য জয়ের পর ফুটবল বিশ্বকাপ কিছুটা হলেও ক্রিকেটের কাছে ম্লান হয়ে গেল কি না!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর