শনিবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

কিডনি-ক্যান্সার চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত রোগী

ডায়ালাইসিসের খরচ মেটাতে হিমশিম ♦ চিকিৎসা পাচ্ছে না গরিবরা ♦ নিঃস্ব হচ্ছে মধ্যবিত্ত

জয়শ্রী ভাদুড়ী

কিডনি-ক্যান্সার চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত রোগী

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী পদে কর্মরত তাইফুল ইসলাম (৩৫)। তার স্ত্রীর দুটি কিডনি দুই বছর ধরে বিকল। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে দুই দিন সরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় ১ হাজার ১২০ টাকা। মাসে ৬ হাজার ৭২০ টাকা। এর সঙ্গে ওষুধ, চিকিৎসক, যাতায়াত মিলিয়ে মাসে ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায় চিকিৎসার পেছনে। স্বল্প বেতনে চাকরি করি। এসব চালাতে গিয়ে দেনায় জড়িয়ে গেছি। বেসরকারি হাসপাতালে এ খরচ দ্বিগুণের বেশি। কতদিন চালাতে পারব জানি না।’

দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুরারোগ্য ব্যাধি কিডনি ও ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রায় ২ কোটি মানুষ কিডনি রোগে ভুগছে। প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যান্সারে। কিডনি ও ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায় খরচ বহন করতে হিমশিম খায় রোগীর স্বজনরা। গলা কাটা চিকিৎসা ব্যয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে রোগী। খরচ মেটাতে অসহায় মধ্যবিত্তরা; ধুঁকছে নিম্নবিত্ত-হতদরিদ্ররা। কিডনি প্রতিস্থাপনকে সমাধানের পথ হিসেবে মনে করছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু সেখানেও রয়েছে কিডনির অপ্রতুলতা।

নানা ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু দেশে আক্রান্তের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় কাজে আসছে না কোনো উদ্যোগ। চিকিৎসা কেন্দ্র, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটে ক্যান্সার চিকিৎসা। সংকট কাটাতে দেশের আট বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, সাধারণত ফুসফুস, স্তন, জরায়ুমুখ, মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী বেশি। এ ছাড়া খাদ্যনালি, পাকস্থলী, লিভার, বাকযন্ত্র, পায়ুপথ, ডিম্বাশয়, বৃহদান্ত, সারভাইরাকাল, লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় মানুষ।

রংপুরের কৃষক সিরাজুল ইসলামের স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত। এই কৃষক ইতোমধ্যে তার কৃষিজমি ও গবাদি পশু বিক্রি করে দিয়েছেন। গত তিন বছরে স্ত্রীর ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপি ও ওষুধের খরচ চালাতে এখন ঋণগ্রস্ত সিরাজুল। ঢাকায় থাকার মতো একটি বাসা ভাড়া নেওয়ার সামর্থ্য নেই এ দম্পতির। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বাইরে একটি আবর্জনার স্তূপের পাশে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে টাকা ধার করতে পারলে আমার স্ত্রী কেমো পায়। ধার করতে না পারলে নির্দিষ্ট তারিখে কেমো দেওয়াতে পারি না।’ এ রোগের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত তার ৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান। ‘ডিজিজ-স্পেসিফিক ডিসট্রেস হেলথকেয়ার ফাইন্যান্সিং অ্যান্ড ক্যাটাস্ট্রোফিক আউট-অব-পকেট এক্সপেনডিচার ফর হসপিটালাইজেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ২৬ শতাংশ পরিবার গত কয়েক বছরে হাসপাতালে ভর্তির জন্য বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় (সিএইচই) করেছে। এ ধরনের ব্যয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ক্যান্সার (৫০ শতাংশ), এর পরই রয়েছে যকৃতের রোগ (৪৯.২ শতাংশ) এবং পক্ষাঘাত (৪৩.৬ শতাংশ)। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশের সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসায় ধরনভেদে অপারেশন, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি দিয়ে শুধু চিকিৎসা খরচ ২-৩ লাখ টাকা পড়ে যায়। এর সঙ্গে যাতায়াত, ওষুধপত্রসহ আনুষঙ্গিক আরও খরচ হয়। বেসরকারি মাঝারি মানের হাসপাতালে এ খরচ প্রায় ১০-১২ লাখ টাকা পড়ে যায়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার আওতায় আসতে পারে মাত্র ৫ শতাংশ ক্যান্সার রোগী। বাকি ৯৫ শতাংশ রোগীর মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা বেসরকারি হাসপাতালে যায়। দেশে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষের চিকিৎসার অবস্থা করুণ। ক্যান্সার ইনস্টিটিউটটে ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিনের পাঁচটিই নষ্ট। ঢাকা মেডিকেলেও একই অবস্থা। রেডিওথেরাপির তারিখ পেতে ছয় মাস লেগে যায়। ততদিনে রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে স্বাস্থ্যবীমা জরুরি। কিন্তু এর তেমন অগ্রগতি নেই। সরকারের একার পক্ষে এত রোগীর সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই বেসরকারি ক্লিনিকগুলোয় খরচ কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে তাদের প্রণোদনা, সুবিধা কিংবা আইন করে খরচ কমাতে বাধ্য করতে হবে। দেশের ধনী ব্যক্তিদের চ্যারিটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় উৎসাহিত করতে হবে।’ ক্যান্সারের মতোই আরেক ভয়াবহ ঘাতক কিডনি রোগ। রোগী ও স্বজনদের সর্বস্বান্ত করে দেয় এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়। কিডনি অকেজো হওয়ার পর ডায়ালাইসিস করে বেঁচে থাকতে কিডনি রোগীদের ১২ থেকে ২২ শতাংশের সম্পদ বিক্রি করতে হচ্ছে। দেশের কিডনি রোগীদের এক শতাংশের কম কিডনি প্রতিস্থাপনের সুবিধা পায়। তবে কিডনি রোগটি প্রাথমিক অবস্থায় নিরূপণ করতে পারলে চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় নেফ্রলজিস্ট নেই। চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকেই মধ্যপথে বন্ধ করে দিচ্ছে চিকিৎসা। চিকিৎসক ও চিকিৎসার অপর্যাপ্ততা এবং মৃত ব্যক্তির কিডনি সংগ্রহে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সম্প্রতি সারাহ ইসলাম নামে এক তরুণী তার দুটি কিডনি ও কর্নিয়া দান করে গিয়ে চারজন মানুষকে সুস্থ জীবন ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার এ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান অন্যদের উদ্বুদ্ধ করলে আরও অনেকের জীবন বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. শেখ মইনুল খোকন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস ও ট্রান্সপ্লান্ট হলে চিকিৎসা নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে যেতে হয়। কিডনি ডায়ালাইসিস করতে রোগীকে নিয়ে আসতে-যেতে আরেকজনকে আসতে হয়। রোগী নিজেও কর্মক্ষম থাকে না, আবার পরিবারের আরেকজন কর্মক্ষম ব্যক্তিকে তার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়। আমাদের কাছে অনেক রোগী শুরুতে কেবিন নিয়ে চিকিৎসা করে কিন্তু একটা সময় তারা খরচ চালাতে না পেরে বিনামূল্যের শয্যা চায়। আমরা ভর্তুকি দিয়ে হলেও রোগী না পারলে তাকে ডায়ালাইসিস দিয়ে থাকি। কিন্তু একে তো সারা দেশের চিত্র বলা যায় না।’

সর্বশেষ খবর