শিরোনাম
রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
বাংলা ব্যবহারে হীনমন্যতা বেশি উচ্চবিত্তের মধ্যে

নামফলক বাংলায় না লিখলে কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন

কামাল চৌধুরী

নামফলক বাংলায় না লিখলে কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োজন

বাঙালির ভাষা ও সাহিত্যের নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই চর্যাপদে। তারপর হাজার বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য এখন স্বমহিমায় আলোকিত। বাংলা ভাষার শুরু থেকে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি, বাঙালি বহু আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেও প্রথমবারের মতো বাঙালির স্বাধিকারবোধের সামষ্টিক উৎসারণ ঘটে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এ আন্দোলন আমাদের পথ দেখিয়েছে নিজস্ব স্বপ্নে, স্বাধিকারের জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছে। এ ঐক্য ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল শক্তি। এ পথ ধরেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। বাঙালির কোনো জাতিরাষ্ট্র ছিল না। আমরা সেই জাতিরাষ্ট্র অর্জন করেছি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে। এ অর্জনের পেছনে ভাষা আন্দোলন ও আত্মত্যাগের একটা ধারাবাহিকতা আছে।

ভাষা আন্দোলনের যে তাৎপর্য সেটি আজ শুধু বাংলাদেশে বা বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে নয়, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। সারা পৃথিবী ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের দিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে। ভাষার জন্য বাঙালি ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের যে অভূতপূর্ব ইতিহাস তৈরি করেছে তা আজ পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের প্রেরণার উৎস। তাই ভাষা আন্দোলন আমাদের ইতিহাসে যেমন, তেমনি সারা পৃথিবীর মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষের কাছে অসাধারণ তাৎপর্যের বার্তাবহ।

ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য, বিশ্ববাসী ভাষা আন্দোলনকে কোন প্রেক্ষাপটে উদযাপন করছে তা আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা দরকার। তবে কাজটি সহজ নয়। ভাষা আন্দোলন হয়েছে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের পটভূমিতে। আজকে সারা পৃথিবী বিশ্বায়নের যুগে। এখানে ভাবের আদান-প্রদান হচ্ছে দ্রুত। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে বদলে গেছে চেনা জগৎ। বিভিন্ন ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে আমাদের সংমিশ্রণ সহজতর হয়েছে আগের তুলনায়। পাশাপাশি আমাদের ভাষায় যে সব বড় কাজ হচ্ছে, অর্থাৎ সাহিত্য, গবেষণা, বিজ্ঞান ও দর্শনে সে কাজগুলো বিশ্বসমাজে তুলে ধরা প্রয়োজন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০২৩’ উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে ব্যাপকভাবে তুলে ধরার জন্য অনুবাদের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আজকে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। আমাদের ওপরে বিরাট দায়িত্ব এসে গেছে। সেটি হলো বাংলা ভাষাকে বিশ্বদরবারে আরও ব্যাপকভাবে পরিচিত করা। কিন্তু সেটা করতে হলে সবচেয়ে দরকার অনুবাদ। অনুবাদ-সাহিত্যের ওপরে জোর দেওয়া।’ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলা সাহিত্যিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যথাযথভাবে তুলে ধরার লক্ষ্যে আশু উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বিশ্বায়নের ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। এর ফলে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র যেমন প্রসারিত হয়েছে, তেমনি সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রও বিস্তৃত। বিশ্বের প্রভাবশালী ভাষার আগ্রাসনের কারণে অনেক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক ভাষা অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। পৃথিবীতে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অসমতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অসমতাও প্রকট। সৃজন ও মনন জগতের সিংহভাগ এখন তাদের দখলে।

বিশ্বায়নের এ সময়ে নানা ভাষার সংমিশ্রণের ফলে এক ধরনের হাইব্রিড ভাষার ব্যবহারও হচ্ছে। ভাষার দূষণ ঘটছে। উচ্চারণে বিকৃতি ঘটছে। এ পরিস্থিতিতে নিজ ভাষা সম্পর্কে জানা এবং এর সংরক্ষণ ও বিকাশে সচেতন হওয়া জরুরি। এমনকি দেখা যাচ্ছে আমাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের অফিস, দোকানপাটের নামফলকে বাংলা ব্যবহার করছে না। যা খুবই দুঃখজনক। এটি একুশের শহীদদের প্রতি অবমাননার শামিল। যারা নামফলকে বাংলা লিখছে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আমরা অনেক সময় লক্ষ্য করি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেখানে ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের উপস্থিতি নেই, সেখানেও অন্য ভাষায় কথা বলে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। এটা এক ধরনের হীনম্মন্যতা। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা ভাষা ব্যবহারে হীনম্মন্যতা সবচেয়ে বেশি উচ্চবিত্তের মধ্যে, তারা তাদের সন্তানদের বিয়ের নিমন্ত্রণ ইংরেজিতে দিয়ে এলিটিসিজমের সুখ অনুভব করেন। ভাষার বিরুদ্ধে আগ্রাসন ও হীনম্মন্যতা- এ দ্বিমুখী প্রতিকূলতা সম্পর্কে তরুণ সমাজকে সচেতন করতে হবে। তাদের জানাতে হবে আত্মত্যাগের ইতিহাস। ভাষার সঙ্গে জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির সম্পর্ক। এ সম্পর্ক যদি সমুন্নত রাখা না যায় তাহলে একটা জাতির অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

লেখক : ভাষা ও সাহিত্যে একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব।

সর্বশেষ খবর