মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

রক্তস্নাত কালরাত ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

ওয়ালিউর রহমান

রক্তস্নাত কালরাত ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগের কথা বলছি। বসন্তের পড়ন্ত বিকালে প্রান্তরে প্রান্তরে সবুজের সমারোহ। ধীরে ধীরে নীলাভ আকাশ গোধূলির রঙে রক্তিমাভ হয়ে আসে, নামে নিগূঢ় কালো অন্ধকার রজনী। শান্ত স্বভাবের বাঙালি একটু স্বস্তির প্রতীক্ষায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখনো পড়ার টেবিলে, কেউ হয়তো ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আঃ! সবুজে ঘেরা এ প্রান্তর ঢেকে যায় কালো ছায়ায়, বিভীষিকাময় ২৫ মার্চ ইতিহাসের কালরাতে। অন্ধকার। ওই যে ট্যাংকারের গর্জন শোনা যায়। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শুনতে পাও কি!... পাকিস্তানি সেনাদের বুলেটে রক্তে রঞ্জিত হলো সেই ক্ষণে বঙ্গোপসাগরের স্রোতস্বিনী। বিভীষিকা আঘাত হেনেছিল প্রতিটি হৃদয়ে। রক্তস্নাত নিথর দেহ! পড়ে আছে প্রান্তরে, প্রাঙ্গণে! মহাবিভীষণ। বাতাসে তখন ভেসে ছিল বুক চেরা তাজা রক্তের গন্ধ!... বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কিছুদিন আগের ভাষণটি অনুরণিত হচ্ছিল ধ্বনিতে ধ্বনিতে। কে যেন উদ্বেলিত করেছিল বাংলার প্রতিটি তারুণ্যের হৃদয়। তারুণ্যের উন্মাদনা, স্বতঃস্ফূর্ততা, ভালোবাসা ও মুক্তিযুদ্ধের আমেজ। দিকে দিকে জেগেছে রব, সে রব স্বগৌরব চেতনায়। যে রবে জেগেছিল প্রতিরোধের জয়ধ্বনি। সে জয়ধ্বনিতে রণিত হয়েছিল বাংলার আকাশ-বাতাস। প্রতিধ্বনিত হয়েছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন। বয়ে চলা শৃঙ্খলমুক্তির স্বপ্ন। লয়ে চলা যাতনা, অকথ্য লাঞ্ছনা! বৈষম্য! দিকে দিকে ধিক্কার, জনতার হাহাকার, অনাদর অবজ্ঞায় ক্ষুধার্ত শিশুর বুকফাটা চিৎকার, নিপীড়িতের আর্তনাদ আর শোষণের নির্মমতায় দূষিত বায়ু। এরপর আসে ৭ মার্চ। শোনো শোনো, বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠে আহ্বান- ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ওরা সে স্বপ্ন মুছে দিতে চাচ্ছে! চলছে, ২৫ মার্চ কালরাতের বিভীষিকা! কান পেতে শোনো... পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছিল, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন। এ জন্য ওইদিন পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত রেখেছিল ঢাকা আক্রমণের জন্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর গোপন পরিকল্পনা তৈরি করে এবং বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের কাছে খুব সতর্কতার সঙ্গে এ অপারেশনের পরিকল্পনার বিষয় গোপন রাখা হয়। অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ ও বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করা; যা ছিল পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২৫ মার্চ রাতে ২২ বেলুচ রেজিমেন্ট পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসকে ঘুমন্ত অবস্থায় আক্রমণ করে এবং অগণিত বাঙালি সেনাকে হত্যা করে। ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ চালিয়ে অধিকাংশ বাঙালি পুলিশকে হত্যা করে ওই রাতেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে আক্রমণ করে এবং হাজার হাজার নিয়োগপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাকে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালিয়ে ১২ জন শিক্ষকসহ অগণিত শিক্ষার্থীকে হত্যা করে। ২৫ মার্চের আক্রমণে বাঙালি শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সামরিক-বেসামরিক বাহিনীর সদস্য, সাধারণ মানুষসহ লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং মিডিয়া হাউসগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। অপারেশন সার্চলাইটের নামে পাকিস্তান বাহিনীর অতর্কিত হামলায় মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠে সমগ্র ঢাকা শহর। পৃথিবীবাসী অবাক হয়ে দেখেছে ধর্মের নামে বর্বর হানাদার বাহিনী কীভাবে এক রাতে প্রায় অর্ধলাখ ঘুমন্ত বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সমগ্র ঢাকা শহর যেন লাশের স্তূপ, ঘুমন্ত শিশু মায়ের কোলেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে, নববধূ, আবালবৃদ্ধবণিতার রক্তে কলঙ্কিত হয়েছিল মানবসভ্যতার হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস। এ রাতে একদিকে প্রত্যক্ষ করেছে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি রাষ্ট্রের জন্মমুহূর্ত, অন্যদিকে রচিত হয়েছে বিশ্বের জঘন্যতম গণহত্যার ইতিহাস। সোনালি দিনের স্বপ্নে সেদিন বাংলার আপামর জনতা নেমেছিল মুক্তিযুদ্ধে। দিয়েছিল জীবন, ৩০ লাখ প্রাণের বিসর্জন। ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম। ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। বিশ্বমানচিত্রে উদিত সোনার বাংলাদেশ। রক্তিম সূর্য। স্বাধীনতা। পরম পাওয়া। একটি ইতিহাস। বিশ্বের বুকে গর্বভরে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো একটি নাম- বাংলাদেশ। আমাদের হৃদয়ে গ্রথিত করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের বর্বরতার মর্মবেদনা, ২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যার স্মৃতি বয়ে চলার যাতনা। এ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দরকার।

‘জেনোসাইড কনভেনশন, ১৯৪৮-এর অনুচ্ছেদ ২’-এ বলা হয়, Genocide means any of the following acts committed with intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnical, racial or religious group, as such: (a) Killing members of the group; (b) Causing serious bodily or mental harm to members of the group; (c) Deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in whole or in part-. সে হিসেবে ২৫ মার্চের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ‘গণহত্যা’। আমাদের চাই এ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির ব্যাপারেও আলোচনা হয়। যদিও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫, রেজুলেশন নম্বর ৬৯/৩২৩ অনুসারে ‘৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। বিগত সময়গুলোয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জাতিসংঘ ও জেনেভায় মানবাধিকার পরিষদে ‘ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং’ বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করা হয়। এ জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সাধুবাদ জানাই এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপের জন্য। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে একটু সময় লাগতে পারে। ‘রুয়ান্ডা গণহত্যা’ জাতিসংঘে স্বীকৃতি পেয়েছে কারণ এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আমেরিকার Ambassador-at-large Stephen Ralph । আর্মেনিয়ায় গণহত্যা চলে (১৯১৫-১৯১৭), এতে প্রায় ১৫ লাখ লোক নিহত হয়েছে। এ গণহত্যার দীর্ঘ ৬৮ বছর পর আমেরিকার সিনেটে স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৮৫ সালে, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের স্বীকৃতিও পায় ১৯৮৫ সালে এবং ১৯৮৭ সালে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে। বাংলাদেশ সরকার ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব রাখার পাশাপাশি এ দাবিকে সফল করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র এবং বর্তমান বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ২৫ মার্চ গণহত্যার ভয়াবহতার তথ্য প্রকাশ এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কূটনৈতিক আলোচনা গুরুত্বের সঙ্গে চালাবে বলে আশা করি। আমাদের এ দাবি একটি বৃহৎ জাতীয় স্বার্থ, সুতরাং জাতিসংঘে যাওয়ার আগে ২৫ মার্চ বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার একটি তথ্যবহুল রিপোর্ট খুবই সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তুত করে জাতিসংঘে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। এ স্বীকৃতি বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেবে বর্বরতার ইতিহাস। বিশ্ববাসীর হৃদয়পটে উদ্রেক হবে মানবতার। হবে বিশ্বজাগরণ। সে জাগরণে নিপাত যাবে পৃথিবীর ইয়াহিয়া-ভুট্টোরা। জাতিসংঘ বাংলাদেশের এ দাবিকে স্বীকৃতি দেবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা...

লেখক : গবেষক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক বিশেষ দূত।

সর্বশেষ খবর