রব্বুল আলামিন, যিনি বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক, আল্লাহ তায়ালার নিকট লাখোকোটি শুকরিয়া আদায় করছি। তিনি আমাদের মাহে রমজানের রোজা পালনের তওফিক দান করেছেন। আমরা সর্বাবস্থায় তাঁর ওপর তাওয়াককুল করি। যিনি আল্লাহর ওপর তাওয়াককুল করবেন তার জন্য আল্লাহ যথেষ্ট হবেন। তাকে অসংখ্য-অগণিত রিজিক দান করবেন। পবিত্র কোরআনের বাণী দ্বারা আমরা এমনই বুঝতে পারি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘এবং তাকে এমন স্থান হতে রিযিক দান করবেন, যা তার ধারণার বাইরে। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করবে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তাহরিম-৩) আসুন আমরা তাওয়াককুলের অর্থ যেনে নেই। তাওয়াককুল আরবি শব্দ। এর অর্থ, ভরসা করা, নির্ভর করা। ‘তাওয়াককুুল আলাল্লাহ’ এর অর্থ : রব্বুল আলামিনের ওপর ভরসা করা। রব্বুল আলামিনের ওপর তাওয়াককুল করা গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারও ওপর কোনোভাবেই তাওয়াককুল করা যায় না। তাওয়াককুল হবে একমাত্র আল্লাহর ওপর। যেমন একজন প্রকৃত মুসলমান বলে থাকেন “তাওয়াক্কালনা আলাল্লাহ” আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করি। একজন প্রকৃত ঈমানদার ব্যক্তি ভালো ও কল্যাণকর বিষয় হাসিলের জন্য নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করবে, সার্বিক প্রচেষ্টা চালাবে আর ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করবে, তাঁর প্রতি আস্থা ও দৃঢ় ইয়াকিন রাখবে। বিশ্বাস রাখবে যে, আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন ফলাফল তা-ই হবে। আর তাতেই রয়েছে পরিপূর্ণ কল্যাণ ও সফলতা। এটাই তাওয়াককুলের মূলকথা। মজবুত ইয়াকিন রাখতে হবে যে, রব্বুল আলামিনের সব ফয়সালা বান্দার কল্যাণের জন্যই হয়ে থাকে। এই বিষয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে ইয়াকিন রাখতে হবে যে, তাওয়াককুলের নীতি অবলম্বনকারী কখনো হতাশ হয় না। আশা ভঙ্গ হলে মুষড়ে পড়ে না। বিপদাপদে ও সংকটে ঘাবড়ে যায় না। যে কোনো দুর্বিপাক, দুর্যোগ, সংকট, বিপদ, বালা-মুসিবতে আল্লাহ তায়ালার ওপর দৃঢ় আস্থা রাখে। ঘোর অন্ধকারে আশা করে উজ্জ্বল সুবহে সাদিকের। আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা বা তাওয়াককুল তাওহিদের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ।
এ সম্পর্কে মহান রব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন- ‘আর তুমি ভরসা কর এমন চিরঞ্জীব সত্তার ওপর যিনি মরবেন না।’ [সুরা আল ফুরকান, আয়াত : ৫৮] অপর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর আল্লাহর ওপরই মুমিনদের ভরসা করা উচিত।’ [সুরা ইবরাহীম, আয়াত : ১১]
অন্য আয়াতে তিনি বলেন- ‘অতঃপর তুমি যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর।’ [সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯] অন্য আয়াতে এসেছে। ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্যে যথেষ্ট।’ [সুরা আত-তালাক, আয়াত : ৩] অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে। ‘মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে ওঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের ওপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে।’ [সুরা আল আনফাল, আয়াত : ২] এ ছাড়াও আরও অনেক আয়াতে তাওয়াককুল সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে। এ সম্পর্কিত অনেক হাদিস এসেছে, যেমন, হযরত ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছি। আপনার ওপরই ঈমান এনেছি। আপনার ওপরই তাওয়াককুল (ভরসা) করেছি। আপনার দিকেই মনোনিবেশ করেছি। আপনার জন্যই তর্ক করেছি। হে আল্লাহ! আপনার সম্মানের মাধ্যমে আশ্রয় প্রার্থনা করছি- আর আপনি ছাড়া তো কোনো উপাস্য নেই- যেন আমাকে পথভ্রষ্ট না করেন। আপনি চিরঞ্জীব সত্তা, তাঁর কোনো ক্ষয় নেই। আর মানুষ ও জিন্নাতের ক্ষয় আছে এবং তারা মারা যাবে।’ হযরত ইবন আব্বাস রাযি. থেকে আরও বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হলো, তখন তিনি বললেন, হাসবুনাল্লাহু ওয়া-নিমাল ওয়াকিল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি উত্তম অভিভাবক)। আর লোকেরা যখন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথীদের বলল, (শত্রু বাহিনীর) লোকেরা তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হচ্ছে, তাই তোমরা তাদের ভয় কর, তখন তাদের ঈমান বেড়ে গেল এবং তারা বলল, হাসবুনাল্লাহু ওয়া-নিমাল ওয়াকিল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট তিনি উত্তম অভিভাবক)।’ হযরত ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বুখারির আরেকটি বর্ণনায় আছে, ‘আগুনে নিক্ষেপকালে ইবরাহিম আলাইহিস সালামের শেষ কথা ছিল, হাসবুনাল্লাহু ওয়া-নিমাল ওয়াকিল (আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট তিনি উত্তম অভিভাবক)।’ এসব আয়াত ও হাদিসসমূহ থেকে আমরা মোটামোটি ছয়টি বিষয়ের শিক্ষা পাই। এক. কোনো ব্যক্তি যখন সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও তাওয়াককুল করবে, তাঁর জন্য রয়েছে অসংখ্য-আগণিত নিয়ামত, প্রতিদান ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। দুই. তাওয়াককুল তো এমন সত্তার ওপর করা উচিত, যিনি চিরঞ্জীব। তিনি হলেন আল্লাহ। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারও ওপর তাওয়াককুল করা জায়েজ নয়। তাওয়াককুল-ভরসা একমাত্র আল্লাহর ওপরই করতে হবে। তিন. আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল রাখা মুমিনদের একটি বৈশিষ্ট্য। চার. আল্লাহ তাঁর রসুলদেরকে-ও সর্বাবস্থায় তাঁর ওপর তাওয়াককুল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পাঁচ . আল্লাহর ওপর তাওয়াককুলকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন। সুতরাং আল্লাহর ভালোবাসা লাভের একটি কার্যকর উপায় হলো তাওয়াককুল ও আল্লাহর ওপর ভরসা করা। ছয়. আল্লাহর ওপর তাওয়াককুলকারীর সাহায্যের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। মহান রব্বুল আলামিন আমাদেরকে সর্বাবস্থায় আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।