মঙ্গলবার, ৬ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা
সাক্ষাৎকার । জি এম কাদের

ক্ষমতায় বসানো নামানোর জন্য রাজনীতি করি না

♦ বিএনপির প্রত্যাশা ছিল জাতীয় পার্টিও সংসদ থেকে পদত্যাগ করবে ♦ বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট সম্ভব নয়

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

ক্ষমতায় বসানো নামানোর জন্য রাজনীতি করি না

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, আমরা কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য রাজনীতি করি না। বিএনপির সাত এমপি সংসদ থেকে পদত্যাগের সময় তাদের প্রত্যাশা ছিল জাতীয় পার্টিও সংসদ থেকে পদত্যাগ করবে। তিনি বলেন, সবকিছুই যেখানে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে সেখানে বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। বর্তমান সরকারের কঠোর সমালোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মন্ত্রিত্ব বা সরকার থেকে সুযোগ-সুবিধা পেলেই চুপ হয়ে যাব- এ ধরনের প্রচারণা সঠিক নয়। জাতীয় পার্টি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করছে। রবিবার বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। এ সময় সাবেক এই মন্ত্রী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক অবস্থাসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন।

জাতীয় পার্টির প্রধান উপদেষ্টা রওশন এরশাদের নেতৃত্বে ৪২ জেলায় পৃথক কমিটি গঠন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জি এম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টির নাম ব্যবহার করলেই এটা জাতীয় পার্টি নয়। এটা জাতীয় পার্টিকে দুর্বল করা বা সমস্যায় ফেলার মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা খুব একটা উদ্বিগ্ন নই। জাপার সাংগঠনিক বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতি সপ্তাহেই দু-তিনটা কাউন্সিল হচ্ছে। করোনাকালে আইনি বাধায় পিছিয়ে পড়েছি। আশা করি, আগামী বছরের জুলাই-আগস্টে সব জেলা সম্মেলন করে জাতীয় সম্মেলন করতে পারব। পাশাপাশি অঙ্গ-সংগঠনগুলোর কমিটি গঠনের কাজও চলছে। মার্কিন ভিসানীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জি এম কাদের বলেন, আমেরিকার ভিসানীতি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে। যারা এ নীতি ঘোষণা করেছেন তারা কতটা কার্যকর করেন তার ওপর নির্ভর করবে সবকিছু। নীতিমালা হিসেবে এটা কার্যকর হবে বলে আমার বিশ্বাস। সুষ্ঠু ভোটের জন্য এগুলো সহায়ক। বর্তমান সরকার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, বাকশালের আদলে দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ প্লাস। আওয়ামী লীগের প্রধান যারা তারা এখন আওয়ামী লীগ প্লাস পরিচালনা করছেন। আওয়ামী লীগ প্লাসের মধ্যে আওয়ামী লীগ, প্রশাসন, পুলিশ, প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ সবাই। কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের এক শিক্ষিত ও মার্জিত নেতা যেভাবে প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে, বিচার বিভাগও আওয়ামী লীগ প্লাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা এতটাই শক্তিশালী যে, আওয়ামী লীগ প্লাসের নির্দেশনা মেনে চলা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। কেউ না মানলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। মনে হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনও আওয়ামী লীগ প্লাসের সদস্য হয়েছে। এতে দেশের মানুষের জন্য স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা নেই। এমন বাস্তবতায় মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, মেধার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া বা মানবাধিকার রক্ষার জন্য কাজ করা আওয়ামী লীগ প্লাসের বাইরে চিন্তা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ প্লাসের বাইরে বের হতে না পারলে দেশে সঠিক রাজনীতি সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, যে কাঠামোতে বাকশাল তৈরি করা হয়েছিল ঠিক তেমন করেই আওয়ামী লীগ প্লাস সৃষ্টি করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন করে বাকশাল করা হয়েছিল কিন্তু আওয়ামী লীগ প্লাস আইনগতভাবে করা হয়নি। যেমন বাকশালের জন্য কিছু আইন করা হয়েছিল; যা আওয়ামী লীগ প্লাসের জন্য নেই। তাছাড়া সব সংস্থাই ওই দলের সদস্যের মতো কাজ করছে। তারা যাকে যেখানে কাজ করতে বলবেন, তিনি সেখানেই কাজ করবেন। অথবা যাকে নির্বাচন করতে বলবেন তিনি নির্বাচিত হবেন। এভাবেই আওয়ামী লীগ প্লাস একটি দল দাঁড়িয়ে গেছে। সদস্য হোক বা না হোক, ইচ্ছায় হোক আর না হোক, সবাই সেই দলের নিয়ন্ত্রণে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, যখন সবকিছুই আওয়ামী লীগ প্লাস বা সে দলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্বাচনে ফলাফল অসম্ভব এবং তারা কখনোই পরাজিত হতে চাইবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে যখন যে সরকার আসে তারা নিজের আয়ত্তে ভোট করতে চায়। আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান অনুযায়ী আগামীতে ভোটের কথা। ’৯১ সালের নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হয়নি। নির্বাচনব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখার দাবি অতীতে ছিল, এখনো আছে। ২০১৪, ২০১৮-এর ধারায় ’২৪ সালে নির্বাচন হলে ভোটের প্রয়োজন হবে না। একটা তালিকা করে গেজেট প্রকাশ করলেই হবে। পয়সা নষ্ট করার মানে নেই। তিনি বলেন, জনসমর্থন থাকলে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। যদি আগামীতে সুষ্ঠু ভোট হয় তাহলে দেশ গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে পারবে। বিএনপি আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন বর্জনের কথা বলছে। জাতীয় পার্টি নির্বাচনের বিষয়ে কী ভাবছে- জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, আমরা পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেব। বিএনপির সংসদ বর্জন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমাদের সংসদ থেকে পদত্যাগের অফার দেওয়া হয়নি। অনেকে প্রতাশা করেছিল, আমরাও সংসদ থেকে বেরিয়ে আসব। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি নিজস্ব সত্তায় চলবে। আমরা কাউকে ক্ষমতায় বসানো বা কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য রাজনীতি করি না। দেশের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের রাজনীতি। সংসদ থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপি কতটুকু লাভ করতে পেরেছে এটা তাদের বিবেচ্য বিষয়। আমরা বেরিয়ে গেলে আমাদের দল ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ভবিষ্যতে যদি দেখি আমাদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই, এখানে থেকে জনগণও কোনো উপকার পাচ্ছে না তখন আমরা সংসদে থাকব কি না বিবেচনা করব। বিএনপি বলছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ভোট আর আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি কোনো প্রস্তাবনা দেবে কি না- জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে সংবিধানই একমাত্র পথ নয়। নির্বাচন ব্যবস্থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আনতে হবে। অতীতেও সংবিধানের বাইরে নির্বাচন হয়েছে। সংবিধানের ভিতরে থেকেও একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করা যাবে আমরা এমন একটা ধারণা চিন্তা করেছি। ধারণাটা প্রকাশ করব যদি প্রয়োজন হয়। তবে এখন সরকার এদিকে মোটেই পা বাড়াচ্ছে না। আমরা ফর্মুলা দিতে পারব। তবে সরকারকে ছাড় দিতে হবে। সবকিছু আয়ত্তে রাখার ইচ্ছা থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে।

সরকার নমনীয় হবে কি না, জানতে চাইলে বলেন, সরকারের পক্ষে খুব কঠিন। পরিস্থিতি যেভাবে সরকার সৃষ্টি করেছে তাতে সরকার নমনীয় হলে ধ্বংস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিছুটা নমনীয় হলে বাকিরা ঠেলে ফেলে দেবে এমন ভয়-আশঙ্কা তাদের কাজ করে। তারা নমনীয় হতে চাইবে না বলে মনে হয়।

চাওয়া-পাওয়ার হিসাব না মেলার কারণেই সরকারের কঠোর সমালোচনা করছেন কি না? অতীতে জোটের মন্ত্রী থাকাকালীন এত কঠোর সমালোচনা করতে দেখা যায়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে জি এম কাদের বলেন, যখন মন্ত্রী ছিলাম তখন সরকারের সমালোচনা করার মতো অবস্থা ছিল না। মন্ত্রী হলে স্বাভাবিকভাবে আমাকে সরকারকে ডিফেন্ড করতে হবে। আমার মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে খুবই সতর্ক ছিলাম। মন্ত্রিত্বের জন্য আমি কোনোদিন রাজনীতি করিনি। মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার বিষয়ও জনগণ জানে। পরবর্তীতে যখন আমি নির্বাচন করিনি তখন আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মন্ত্রী হওয়ার জন্য, মন্ত্রিত্ব নেইনি। সুযোগ-সুবিধা ও মন্ত্রিত্বের জন্য সরকারের সমালোচনা করছি, মন্ত্রিত্ব পেলেই চুপ হয়ে যাব, এ ধরনের প্রচারণা সঠিক নয়। তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার আর এখনকার আওয়ামী লীগ সরকারে মধ্যে পার্থক্য আছে, এটা জনগণই আমার সঙ্গে একমত হবে নিশ্চয়। তিনি বলেন, পৃথিবীর সব দেশে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করার সুযোগ আছে। আমাদের দেশে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগ নেই। কথা বলার সুযোগ নেই। আবার অমিয়মতান্ত্রিক পথে গেলে কঠোরভাবে দমন করা হয়। এ জন্য বিদেশিরা আমাদের এখানে হস্তক্ষেপ করছে। দেশবাসীর কাছে আশা-ভরসার স্থল হয়ে গেছে বিদেশিরা। সমর্থনও পাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। এর সুযোগও বিদেশিরা নিচ্ছে।

সর্বশেষ খবর