রবিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

প্রতিদিনই গুলি গোলা পড়ছে বাংলাদেশে

♦ টেকনাফের ওপারে সংঘর্ষ ♦ আতঙ্ক কাটেনি সীমান্তে

নিজস্ব প্রতিবেদক

টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় গতকাল সকাল থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ভারী গোলাগুলি ও মর্টার শেলের বিকট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গ্রামের ভিতরে একটি বাড়িতে গুলিও এসে পড়েছে। এ ছাড়া গতকাল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় দুটি গোলা উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয়রা মর্টার শেল বললেও এগুলো মূলত আরপিজি বা রকেট প্রপেলড গ্রেনেড। আরপিজিগুলো নিয়ে কয়েকটি শিশুকে খেলতে দেখে সেগুলো বাড়িতে নিয়ে যান এক নারী। পরে সেগুলো বিজিবির কাছে দেওয়া হয়েছে।

এদিকে কক্সবাজারের উখিয়ায় নাফ নদের তীর ঘেঁষে বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে নির্মাণাধীন সড়কের ঢালে এবং সীমান্তের ওপারে কয়েকটি লাশ পড়ে থাকার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা। গতকাল ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে নতুন করে কোনো গোলাগুলির শব্দ শোনা না গেলেও এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে এসব তথ্য জানা গেছে। বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরের চলমান সংঘাতের জেরে সেখান থেকে পালিয়ে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় আশ্রয় নেওয়া আরও ১৬৬ জন বিজিপি, সেনা ও পুলিশ সদস্যদের দ্বিতীয় দফায় গতকাল রাতে কক্সবাজার স্থানান্তর করা হচ্ছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, উপজেলার ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয় থেকে তিনটি বড় বাস ও কয়েকটি গাড়ির মাধ্যমে তাদের কক্সবাজার স্থানান্তরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বিজিবি কর্তৃপক্ষ। এদিকে বান্দরবানের ঘুমধুমের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, নতুন করে পাওয়া দুটি মর্টার শেল (আরপিজি) লাল পতাকা দিয়ে ঘিরে রেখেছে বিজিবি। খেত-খামার, কৃষিজমিতে মিয়ানমারের এসব শেল পাওয়া যাচ্ছে। অবিস্ফোরিত এসব গোলা সীমান্তের বাসিন্দা ও শিশুরা অনেক সময় না বুঝেই ধরছে, খেলাধুলাও করছে। ফলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। তবে ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে নতুন করে কোনো গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়নি। সর্বশেষ শুক্রবার দুপুরে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তখন এপারে গুলি এসে পড়েছিল। কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের জের ধরে অস্ত্রসহ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের ২৩ নাগরিককে আদালতে সোপর্দ করা হয়। উখিয়া থানা পুলিশ গতকাল বিকালে তাদের কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ফাহমিদা সাত্তারের আদালতে সোপর্দ করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। উখিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মো. শামীম হোসেন জানান, মিয়ানমারের এই নাগরিকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের কাছে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আজ রবিবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রিমান্ডের শুনানি করবেন। তিনি জানান, বিজিবি বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে শুক্রবার দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়া থানায় মামলা দায়ের করে। এ-সংক্রান্ত মামলায় বিভিন্ন ধরনের ১২টি অস্ত্র ও ১৯৫ রাউন্ড গুলি বিজিবির পক্ষে পুলিশকে সোপর্দ করা হয়েছে। ২৩ জনের সবাই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রেজিস্ট্রেশন হওয়া বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক বলে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে শুক্রবার সারাদিন এবং রাতে পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও গতকাল সকাল থেকে টেকনাফ সীমান্ত-সংলগ্ন মিয়ানমারের ভিতর থেকে গুলি আর মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য ছেনুয়ারা বেগম। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় আবদুল আলিমের বাড়ির টিনের চাল ফুটো হয়ে এই গুলি বারান্দার মেঝেতে এসে লাগে। গোলাগুলির একই তথ্য জানিয়েছেন হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারি। ছেনুয়ারা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ভোরবেলায় আমার বাড়ির পেছনেই আবদুল আলিমের বাড়ির টিনের চাল ফুটো হয়ে একটি গুলি বারান্দার মেঝেতে এসে লাগে। ওই সময় বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে ছিল। এখন এলাকার সবাই ভয়ে আছে। এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তারা গোলাগুলির শব্দ পেয়েছেন। চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারি বলেন, গতকাল ভোরে হোয়াইক্যং ইউনিয়নের লম্বাবিল, উনচিপ্রাং, কানজর পাড়া সীমান্তের নাফ নদের ওপারে গুলিবর্ষণ, মর্টার শেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা গেছে। যতদূর জানা গেছে, গতকাল ভোরে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের কুমিরখালী এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবর্ষণ ও মর্টার শেল বিস্ফোরণের এ ঘটনা ঘটে। এতে সীমান্তের এপারের লম্বাবিল ও উনচিপ্রাং এলাকায় কয়েকটি গুলিও এসে পড়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘাতে সীমান্তের বেড়িবাঁধের নিচে পড়ে থাকা অজ্ঞাত লাশটি তিন দিন পর উদ্ধার করেছে পুলিশ। আরও একটি লাশ ওপার থেকে জোয়ারের পানিতে ভেসে এলে সেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।

আরও দুই রকেট লঞ্চার উদ্ধার : মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের জেরে ওপার থেকে আসা আরও দুটি রকেট লঞ্চার উদ্ধার করেছে কৃষকরা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্ত এলাকা থেকে এসব রকেট লঞ্চার উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে এ পর্যন্ত তিনটি রকেট লঞ্চার উদ্ধার করা হলো। এ ছাড়া সীমান্তের লোকেরা ছোট-বড় অন্যান্য গোলা কুড়িয়ে পাচ্ছেন, যার সংখ্যা ২০টির অধিক।

সীমান্তে গুলি কুড়িয়ে পাওয়া তুমব্রু পশ্চিমকূলের রাজিয়া বেগম এই প্রতিবেদককে জানান, গত শুক্রবার বিকালে তিনি তার খেত থেকে মচির তুলতে গেলে রকেট লঞ্চার পেয়ে প্রথমে বাড়িতে নিয়ে যান। পরে বাড়ির সদস্যদের পরামর্শে রাস্তার ধারে রেখে আসেন। একইভাবে পৃথক স্থান থেকে দুটি রকেট লঞ্চার কুড়ে আনেন সীমান্তের নারী-পুরুষরা।

স্থানীয় সূত্রের খবর, গত ২২ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ২ সপ্তাহ ধরে সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি চলছে। এ সময়ের মধ্যে অনেক বুলেট এবং বড় আকারের মরণাস্ত্রের গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশে। এগুলো আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনের লঙ্ঘন।

সর্বশেষ খবর