প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ কার্যালয়, সাবেক রাষ্ট্রপতির বাসভবন, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী (সদ্যসাবেক)-এমপি-নেতাদের বাসভবন, থানা ভবন, গণমাধ্যম, বিচারপতির বাসভবন, সরকারি অফিস, রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ঘটে। গতকাল বিকাল সাড়ে ৩টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে বেশির ভাগ হামলা ঘটে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের ডিউটি অফিসার রোজিনা আক্তার গতকাল বিকালে জানান, ‘এ মুহূর্তে ঢাকার অনেক স্থান থেকে আগুনের খবর পাচ্ছি আমরা। এর মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমন্ডির বাসভবন, আদাবর থানা, খিলক্ষেত থানা, শ্যামপুর থানা, উত্তরা, মিরপুর, তেজগাঁওসহ অনেক স্থানে অগ্নিসংযোগ ঘটেছে। ঢাকার বাইরে থেকেও অগ্নিসংযোগের খবর পাচ্ছি।’
বিকাল ৪টার পর ধানমন্ডির ৩/এ-তে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার কার্যালয়ে আগুন দেন আন্দোলনকারীরা। আগুন দেওয়ার পর ছাত্র-জনতাকে উল্লাস করতে দেখা যায়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় হামলা ও ভাঙচুর করেছেন আন্দোলনকারীরা। ফটক ভেঙে হাজারো আন্দোলনকারী বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়েন। বাড়ির ভিতর থেকে ধোঁয়াও বের হতে দেখা যায়।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ‘গণভবন’ ও জাতীয় সংসদ ভবনও দখলে নেন আন্দোলনকারীরা। বিকাল সোয়া ৩টার দিকে সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে হাজারো মানুষ। প্রথমে তাদের বাধা দেয় সেনাবাহিনী। পরে জনস্রোত বাড়তে থাকায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। অধিবেশন কক্ষে ঢুকে সংসদ সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত চেয়ারে বসে কেউ তোলেন সেলফি, কেউ করেন লাইভ ভিডিও। সংসদ ভবনের ভিতরে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এর আগে দুপুর আড়াইটার দিকে গণভবন দখল করেন আন্দোলনকারীরা। গণভবনের চেয়ার-টেবিল, ফ্যান, গরু, মাছ, মুরগি, হাঁস, বিড়াল, বালিশ-তোশক, কাপড়চোপড়, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, পিতলের বাসনকোসনসহ বিভিন্ন উপকরণ দেখা গেছে মানুষের হাতে হাতে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা বিভিন্ন ভিডিওতে ডাইনিং টেবিলে বসে গণভবনে রান্না করে রাখা খাবার খেতে দেখা গেছে জনগণকে।
বিকাল ৪টার দিকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। বিকাল ৫টার দিকে রাজধানীর ১৯ হেয়ার রোডে অবস্থিত প্রধান বিচারপতির বাসভবনে ঢুকে পড়ে সাধারণ মানুষ। এ সময় তাদের প্রধান বিচারপতির ব্যবহৃত আসবাবপত্র যে-যার মতো নিয়ে উল্লাস করতে দেখা যায়।
বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ও এর পাশের দুই ভবনে আগুন দেয় উৎসুক ছাত্র-জনতা। এ সময় সেখানে ভাঙচুর চালায় তারা। এর আগে ভবন থেকে আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যায় তারা।
রাজধানীর রমনায় ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের বাসভবন ও মিন্টো রোডে মন্ত্রিপাড়ায় প্রতিমন্ত্রীদের বাসায় বাসায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। হামলাকারীরা ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের বাসভবন থেকে বিভিন্ন আসবাবপত্র নিয়ে যায়। গতকাল সন্ধ্যার মধ্যে রাজধানীর অন্তত ১২টি থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বাড্ডা, শ্যামপুর, ভাটারা, খিলগাঁও, খিলক্ষেত, কদমতলী, শাহবাগ, রামপুরা, উত্তরা পূর্ব, উত্তরা মডেল, যাত্রাবাড়ী এবং মিরপুর থানায় হামলা ঘটেছে। এ সময় জনরোষ থেকে বাঁচতে একের পর এক গুলি ছোড়ে পুলিশ। এ ছাড়া একাত্তর টিভি, সময় টেলিভিশন, মাইটিভিসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে হামলা ও ভাঙচুর চালায় উৎসুক জনতা।
ঢাকার বাইরে থেকেও হামলার খবর জানিয়েছেন আমাদের সংবাদকর্মীরা। কিশোরগঞ্জ : কিশোরগঞ্জ শহরের খড়মপট্টিস্থ সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাসভবন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ের পাশে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অ্যাডমিন অ্যান্ড গোয়েন্দা-দক্ষিণ) বিপ্লব কুমার সরকারের বাসভবন, জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ আশফাকুল ইসলাম টিটুর বাসভবনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হয়। ভেঙে ফেলা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়। কিশোরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পারভেজ মিয়ার বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। অন্যদিকে ইটনা, বাজিতপুর, নিকলী, কটিয়াদী, কুলিয়ারচর, ভৈরব, করিমগঞ্জ উপজেলাসহ বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ কার্যালয় এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে বলে জানা গেছে। ভৈরবে বিসিবি চেয়ারম্যান নাজমুল হাসান পাপন এমপিসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বাসভবনে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর করা হয়।
নাটোর : বিকাল পৌনে ৫টার দিকে নাটোরের সিংড়ায় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের বাসায় ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সিংড়া পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌসের বাসাও ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় পলকের ছবিসংবলিত সাইনবোর্ডও ভাঙচুর করে বিক্ষুব্ধ জনতা। বিকাল ৪টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ও সদর আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বাসভবনে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এ ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলামের বাসা, যুগ্মসম্পাদক রুহুল আমিন, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক তহিদুল ইসলামের বাসা ও কার্যালয় ভাঙচুর করে জনতা।
ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, জেলা সভাপতি সাবেক এমপি সফিকুল ইসলাম অপু, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু, এমপি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম হিরোন ও পাগলা কানাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাঈদের বাড়িসহ অসংখ্য নেতা-কর্মীর বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভফুচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
আমতলী (বরগুনা) : উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পৌর মেয়র মতিয়ার রহমানের বাসভবন, বরগুনা মহিলা এমপির কার্যালয়, চাওড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান বাদলের অস্থায়ী কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মেয়র মতিয়ার রহমান এ অভিযোগ করেছেন।
বগুড়া : বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় ও বাসভবনে হামলা-অগ্নিসংযোগ করেছে ছাত্র-জনতা। এ সময় উপজেলা চত্বরে অবস্থিত জামে মসজিদ ছাড়া সবকিছু ভস্মীভূত করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ : চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানা, ডিসির বাসভবনসহ বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে পুলিশ সুপারের অফিস, আওয়ামী লীগ অফিস, আওয়ামী লীগ এমপি আবদুল ওদুদের হুজরাপুরের বাসভবন, ওয়ালটন মোড়ের অফিস, মহারাজপুরের পেট্রল পাম্প, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিনের বাসভবনে হামলা ও লুটপাট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া পৌর মেয়র মোখলেসুর রহমানের বাড়ি ও পার্কে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাঁর মালিকানাধীন গ্রামীণ ট্রাভেলসের ডিপোও। পরে সদর থানা ও পুলিশ সুপারের অফিসের নিয়ন্ত্রণ নেন সেনাসদস্যরা।
বরিশাল : বেলা আড়াইটার দিকে নগরের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউর রহমান বিপ্লবের কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এরপর সাবেক সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বাসভবন, সদর রোডে মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়, সিটি করপোরেশনের অ্যানেক্স ভবন, কাকলির মোড় পুলিশ বক্স, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়াম, বর্তমান সিটি মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহর ভাড়া বাসা, নবগ্রাম রোডে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম এমপির বাসভবনে তৃতীয়বারের মতো হামলা-ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সুযোগসন্ধানীরা এ সময় বঙ্গবন্ধু অডিটোরিয়ামে থাকা কয়েক হাজার বস্তা চাল, কম্বল, বরিশাল ক্লাবের সব মালামাল লুট করেছে। ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের নগরের ব্রাউন কম্পাউন্ডে বীরউত্তম ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। নগরের বগুড়া রোডে আমির হোসেন আমু এমপির বাসা ভাঙচুর ও লুট করা হয়। নগরের আওয়ামী লীগপন্থি সব ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়সহ ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ আবিদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বরিশাল সার্কিট হাউসসহ নগরের সব স্থানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভেঙে ফেলা হয়েছে। বরিশালের ১০ উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাসাবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে।
ধামরাই (ঢাকা) : ধামরাই থানা পুলিশ সাধারণ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে জনগণ থানাসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। এ সময় বিক্ষুব্ধরা থানায় মোটরসাইকেলসহ ৫৫টি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, পৌরসভা, ধামরাই প্রেস ক্লাব ও এ সি ল্যান্ডের গাড়ি, থানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
দিনাজপুর : দিনাজপুরে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও তাঁর সহোদর জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিমের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। মেহেরপুর : জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে বিক্ষুব্ধ জনতা। মেহেরপুর প্রেস ক্লাব ও কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করে তারা।
রাজশাহী : আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের উপশহরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। নগরীর নিউমার্কেট এলাকায় থিম ওমর প্লাজায় লুটপাট করে আগুন দেওয়া হয়েছে। মার্কেটটির মালিক রাজশাহী-১ আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী। আগুন দেওয়া হয়েছে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, কাউন্সিলর আবদুল হামিদ সরকার টেকনের বাড়িতে। ডাবলু সরকারের মালিকানায় থাকা একটি আবাসিক হোটেলেও ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দেওয়া হয়। গ্যারেজে থাকা ছয়টি গাড়ি পুড়ে যায়।